প্রকৃতিতে প্রাণীরা নানা উপায়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে; কেউ শব্দ ব্যবহার করে, কেউ রং বা গন্ধের মাধ্যমে। কিন্তু কথা না বলেও যে নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত জটিল তথ্য আদানপ্রদান করা যায় সেটা আমরা জানতে পারি ক্ষুদ্র প্রাণী মৌমাছি থেকে। মৌমাছির তথ্য আদানপ্রদাণের সেই অদ্ভুত পদ্ধতি হলো তাদের বিশেষ ‘নাচ’, যা বিজ্ঞানীদের কাছে আজও বিস্ময়।
মৌমাছি ফুল থেকে মধু বা পরাগরেণু সংগ্রহ করে তা নিয়ে চাকে ফিরে এসে এক অনন্য নাচ শুরু করে। নাচের প্যাটার্ন সাধারণত বাংলা চার বা ইংরেজি আটের (?)-এর মতো। এই নাচের মধ্যবর্তী দোলানো অংশ ফুলের অবস্থান সূর্যের তুলনায় কোন দিকে আছে তা নির্দেশ করে, আর দোলানোর গতি ও সময় নির্দেশ করে সেই ফুল চাক থেকে কত দূরে। অর্থাৎ, মৌমাছি মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে দোলের মাধ্যমে সহকর্মীদের সরাসরি ফুলের দিক এবং দূরত্ব জানায়। তখনই চাকের অন্য মৌমাছিরা ছুটে যায় সেই ফুলের সন্ধানে।
এ আচরণ প্রথম আবিষ্কার করেন অস্ট্রিয়ান প্রাণীবিজ্ঞানী কার্ল ভন ফ্রিশ, যিনি দেখান, মৌমাছি সূর্যের অবস্থান অনুসারে ফুলের দিক নির্ধারণ করতে পারে। মেঘলা দিন বা আলো কম থাকলেও মৌমাছি সূর্যের আলোকরশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মি শনাক্তকরণের ক্ষমতা ব্যবহার করে সঠিক পথ খুঁজে নেয়। এর ফলে ফুলের অবস্থান অন্য মৌমাছিদের কাছে নির্ভুলভাবে পৌঁছে যায় এবং তারা দ্রুততম সময়ে খাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
মৌমাছির এই নাচ শুধু খাদ্য খুঁজে পাওয়ার জন্য নয়, বরং এটি দলগত সমন্বয় ও প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তার নিখুঁত উদাহরণ। চাকের সব সদস্য নাচের সংকেত বুঝে চলে যায়, ফলে পুরো কলোনি একসঙ্গে সংগঠিতভাবে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। এক ধরনের প্রাকৃতিক নেভিগেশন সিস্টেমের মতো মৌমাছিরা পরিবেশকে বিশ্লেষণ করে, সিদ্ধান্ত নেয় এবং কার্যকরভাবে তথ্য আদানপ্রদান করে।
এটি আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে রয়েছে অভিযোজন ও বুদ্ধিমত্তা, যা তাদের টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়ায়। মানুষের তৈরি নেভিগেশন প্রযুক্তির চেয়ে কত নিখুঁতভাবে মৌমাছি এ তথ্য আদানপ্রদান করে, তা দেখলে প্রকৃতির অসাধারণ সৃজনশীলতাকে আমরা আরও কাছে থেকে অনুভব করতে পারি। মৌমাছির নাচ শুধু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি আমাদের প্রকৃতি রক্ষা ও জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করাতেও সাহায্য করে।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়