অতি পরিচিত একটি পাখি কাক। পাখিটি নিয়ে রয়েছে নানান গল্প। প্রচলিত আছে নানান মিথ। এই সাধারণ কালো পাখির ভিতরে লুকিয়ে আছে এক আশ্চর্য জগৎ। মানুষের মতো বুদ্ধি, সামাজিক সম্পর্ক আর আবেগ দিয়ে গড়া সেই জগৎ বিজ্ঞানের কাছেও এক বিস্ময়।
কাক নিয়ে একটি গল্প কমবেশি সবারই জানা। এক দিন শহরের একটি তৃষ্ণার্ত কাককে দেখা গেল অল্প পানিভরা একটি বোতলের কাছে বসে আছে। সেই বোতলে ঠোঁট ঢোকাচ্ছে, কিন্তু পানি পাচ্ছে না। হঠাৎ সে চারদিকে কিছু পাথর দেখল। একে একে কয়েকটি পাথর তুলে বোতলে ফেলল। ধীরে ধীরে পানির স্তর ওপরে উঠল, আর কাকটি স্বাচ্ছন্দ্যে পানি পান করল। মূলত কাকের এই বুদ্ধি কোনো গল্প নয় বরং বাস্তব। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে দেখিয়েছেন, কাক সত্যিই পাথর ব্যবহার করে পানির স্তর বাড়াতে পারে। এই আচরণকে বলা হয় কারণ ও ফলাফল বোঝার ক্ষমতা।
কাকের আরেকটি অদ্ভুত দিক হলো যন্ত্রপাতির ব্যবহার। নিউজিল্যান্ডের ‘নিউ ক্যালেডোনিয়ান কাক’ বাঁকা তারকে সোজা করে নিয়ে লাঠির মতো ব্যবহার করতে পারে। এটি প্রমাণ করে, কাক শুধু পরিবেশ থেকে জিনিস নেয় না, বরং সেটিকে পরিবর্তন করে ব্যবহার করারও ক্ষমতা রাখে। বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রাথমিক ধাপের মতোই।
তবে কাকের বুদ্ধি শুধু সমস্যার সমাধানেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের সামাজিক জীবনও অত্যন্ত জটিল। তারা দলে দলে থাকে, আর বিশেষ ধরনের ডাকের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিপদ এলে তারা সতীর্থদের সতর্ক করে। গবেষণায় দেখা গেছে, কাক মানুষের মুখ চিনে রাখতে পারে। এমনকি যারা তাদের ক্ষতি করে, তাদের বহু বছর মনে রাখে। সেই তথ্য অন্য কাককেও জানিয়ে দেয় যেন পুরো সমাজ মিলে প্রতিশোধ নিতে পারে। বিজ্ঞানীরা এটিকে বলেন সামাজিক শিক্ষা।
আরও বিস্ময়কর হলো, কাক মৃত কাককে ঘিরে জমায়েত করে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় তারা যেন শোক করছে। কিন্তু গবেষকরা মনে করেন, এটি আসলে এক ধরনের শিক্ষার সভা, যেখানে কাকরা বোঝার চেষ্টা করে মৃত্যুর কারণ কী, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অর্থাৎ মৃত্যুকে তারা শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে। সবমিলিয়ে কাক আমাদের চোখে যতই সাধারণ মনে হোক, তারা আসলে প্রকৃতির বুদ্ধিমান ও কৌশলী প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। তাদের আচরণে আমরা যেমন গল্প খুঁজে পাই, তেমনই বিজ্ঞানীরা খুঁজে পান বিবর্তনের রহস্য।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়