স্বৈরাচারের বিদায়ের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ নিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করে গত জুনে। প্রবৃদ্ধি সহায়তার রীতি ভেঙে সে সময় একে ঘোষণা করা হয়েছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাজেট। অথচ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস কিছুটা কমলেও তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরেই বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে, যা আগস্টে ছিল ৮ দশমিক ২৯। এ সময়ে টানা রপ্তানি আয় কমেছে ৪.৬১ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি অনেক আগে থেকেই তলানিতে বিরাজ করছে। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের বোঝা। দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে বেকার হয়েছে। অন্তত ২৮% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি অনেকটা লক্ষ্যহীন পথেই এগিয়ে চলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ছাড়া অর্থবছরের প্রথম মাসে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার। আগের অর্থবছরে এ ঘাটতি ছিল প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। ২২ বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি। সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষের জীবনমানে তেমন পরিবর্তন আসেনি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কমেছে রপ্তানি আয় : অর্থনীতির নানান সংকট সত্ত্বেও কিছুটা স্থিতিশীল ছিল রপ্তানি আয়। কিন্তু এবার সেই আশা ভাঙতে শুরু করেছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এসে তা আবারও হ্রাস পেয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগস্টে রপ্তানি আয় প্রায় ৩ শতাংশ কমার পর সেপ্টেম্বরে আরও ৪.৬১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বেড়েছে রাজস্ব ঘাটতি : চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) শুল্ককর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৪২৩ কোটি। ঘাটতি ৬ হাজার ৫৭৭ কোটি। গত মে ও জুনে এনবিআরের আন্দোলনের কারণে বড় আকারে রাজস্ব ঘাটতি হয়। গত অর্থবছরে টার্গেটের তুলনায় অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বেড়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব : তিন বছরের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। দেশে এখন দারিদ্র্যের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। ২০২২ সালে এ হার ছিল ১৮ দশমিক ৭। এর বাইরে ১৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যে কোনো সময় দারিদ্র্যসীমায় নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা। একই সঙ্গে গত এক বছরে বিপুলসংখ্যক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়ে বেকারের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেকারত্ব বেড়েছে ৪.৬৩ শতাংশ। বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে। নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় এ হার আরও উদ্বেগজনক।
এডিপি বাস্তবায়ন কমেছে : গত বছরের রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্য দিয়ে যাওয়া জুলাই ও আগস্টের চেয়ে পিছিয়ে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। গত জুলাই-আগস্টে এডিপির অর্থ ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ; যা আগের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি ২২ বছরের সর্বনিম্ন : রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ঋণের উচ্চ সুদের প্রভাবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, যার প্রতিফলন পড়েছে ব্যাংকের ঋণপ্রবৃদ্ধিতেও। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আগস্টে এটি ছিল ৬.৩৫ শতাংশ, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ নেই। চালু থাকা কারখানার কিছু অংশও বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করায় ঋণ ব্যয় বেড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
বেড়েছে খেলাপি ঋণ : দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ। গত তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে। এক বছরে এ ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ। এমনকি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়েও ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা বা ৫৩ শতাংশ।
শুধু বেড়েছে রেমিট্যান্স, বেড়েছে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত : শুধু প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ায় চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্তি বাড়ছে অব্যাহতভাবে। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ৪৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত রেকর্ড হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ উদ্বৃত্তি ছিল ১৯১ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, প্রবাসী আয়ে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করেছে। রেমিট্যান্সের এ ইতিবাচক প্রবণতা সামগ্রিক বৈদেশিক খাত আরও শক্ত অবস্থানে এনেছে।