‘পেছনে পুলিশের তাড়া, জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালাচ্ছেন প্রেমিকযুগল রাজ্জাক-ববিতা, একসময় একটি ঝরনার কাছে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় দুজনের। মৃত্যুর সময় ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ পরস্পরকে চুম্বন করেন তারা। শেষ পর্যন্ত ঝরনার তীরে পড়ে থাকে তাদের আলিঙ্গনবদ্ধ প্রাণহীন দেহ।’ মূলত এটাই কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘অনন্ত প্রেম’ ছবির শেষ দৃশ্য। নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত প্রথম ছবি এটি। এতে প্রেমিক জুটি হয়েছিলেন রাজ্জাক ও ববিতা। ১৯৭৭ সালের ১৮ মার্চ ছবিটি মুক্তি পায়। তখন চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা চিত্রালীতে এই যুগলের চুমুর দৃশ্যটির ছবি ছাপিয়ে খবরের শিরোনাম দেওয়া হয় ‘ঢাকার ছবিতে চুমু এলো’। ছবিটি রাজ্জাকের চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন্সেরও প্রথম প্রযোজিত ছবি। পত্রিকায় ছবিটির বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, ‘আকাশ যতদিন থাকবে, এই পৃথিবী যতদিন থাকবে, আমি যে তোমারি থাকব’ সমাজ থেকে পলাতক একটি প্রেমিক আর একটি প্রেমিকার এই সেই শপথ। এ শপথ কি অনন্ত প্রেম? অনন্ত প্রেম প্রথাগত ছবির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছবিটি প্রথম সপ্তাহে ঢাকার বলাকা, জোনাকী, গুলিস্তান, মুন, মানসী ইত্যাদি হলে মুক্তি পেয়েছিল। সে সময়ে বাংলাদেশের একটি সিনেমায় এমন একটা দৃশ্য ছিল যা পৃথিবীর আর কোনো সিনেমায় নেই। নায়ক আর নায়িকা পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। নায়কের দাড়ি শেভ করা দরকার, কিন্তু আয়না নেই। অগত্যা নায়িকার চোখের আয়নায় দাড়ি কাটছে নায়ক। নায়িকার মুখের বেশ কাছে নায়ককে ঝুঁকে আসতে হয়েছে। তাঁরা দুজনের নিঃশ্বাসের উত্তাপ অনুভব করছে। একই সিনেমায় পলাতক নায়ক পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। নায়িকা ঘুমন্ত নায়কের শিয়রে বসে গাইছে ‘আলো তুমি নিভে যাও, যাও, রাত আঁধার হয়ে যাও যাও।’ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক এসব দৃশ্য আর দেখার উপায় নেই। কারণ এই সিনেমাটি হারিয়ে গেছে। তুমুল দর্শকপ্রিয় ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিটির সবকটি গানও পেয়েছিল সমান জনপ্রিয়তা। সংগীত পরিচালক ছিলেন আজাদ রহমান, অবশ্য ‘ঐ আকাশ যতদিন থাকবে, এই পৃথিবী যতদিন থাকবে, আমি যে তোমারই থাকব’, গানটির পরিচালক ছিলেন খন্দকার নুরুল আলম, গীতিকার কাজী আজিজ আহমেদ। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখায় খুরশীদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি’ গানটি সময়ের স্পর্শকে বাঁচিয়ে রেখে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি ক্ল্যাসিক গানে পরিণত হয়েছে। গানটির শুটিং হয়েছিল কাপ্তাইয়ের অসাধারণ সুন্দর সব লোকেশনে।
‘অনন্ত প্রেম’ সম্পর্কে চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামসুল আলম বাবুর লেখা ‘চিত্রসম্পাদক বশীর হোসেন’ বইতে উল্লেখ আছে- ১৯৭৪ সালে খান আতাউর রহমান চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার কাজী আজিজ আহমেদকে দিয়ে ‘অমর প্রেম’ নামে একটি চিত্রনাট্য রচনা করান। চলচ্চিত্রটি তিনিই নির্মাণ করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বশীর হোসেন চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করতে চাইলেন। রাজি হলেন খান আতা। একই সময় একই নামে পরিচালক আজিজুর রহমান একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলে বশীর হোসেন নাম পরিবর্তন করে ‘অনন্ত প্রেম’ নাম দিয়ে নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকেই চলচ্চিত্রটি বানাবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। এজন্য অর্থনৈতিক লেনদেনে অভিজ্ঞ ছোট ভাই মোহাম্মদ আবু তাহের মুন্সিকে অফিস দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব দিলেন। রেজা লতিফের চিত্রগ্রহণে রাজ্জাক, ববিতা ও অন্যদের নিয়ে কিছুদিন শুটিংও করলেন বশীর হোসেন। এ সময় তার অসুস্থতা, সম্পাদনা কাজের ব্যস্ততা এবং অর্থনৈতিক কারণ প্রভৃতির জন্য কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে তখনকার তুমুল জনপ্রিয় নায়ক রাজ্জাক বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করলেও তখন পর্যন্ত কোনো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেননি। তিনি ‘অনন্ত প্রেম’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনায় আগ্রহী হলেন। তিনি প্রথমে বশীর হোসেনের প্রযোজনাতেই পরিচালনা শুরু করলেও পরবর্তীতে বশীর হোসেনের কাছ থেকে চলচ্চিত্র স্বত্ব কিনে নিয়ে, সুরকার খন্দকার নুরুল আলমের পরিবর্তে আজাদ রহমানকে নিয়ে কিছু গান পরিবর্তন করে এবং কাজী আজিজ আহমেদকে দিয়ে চিত্রনাট্যের কিছু অদলবদল করে নির্মাণ করলেন। ‘অনন্ত প্রেম’ চলচ্চিত্রটি এমন বেশ কয়েকটি কারণেই একটি আলোচিত চলচ্চিত্র হয়ে আছে এ দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।