প্লাস্টিক দূষণের পাশাপাশি এখন বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সিসা দূষণ। দেশে সিসার মতো ভারী ধাতুর দূষণ বেড়েই চলেছে। ঢাকায় পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা- আইসিডিডিআরবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় রাজধানীর বস্তি এলাকায় বসবাসকারী ৫০০ শিশুর মধ্যে ৯৮ শতাংশের শরীরেই বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গত আগস্টে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সিসা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় এবং শ্বাসতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এর প্রভাব আরও ভয়াবহ। এতে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, অটিজম, মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হওয়া এবং আচরণগত সমস্যার মতো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে।
সারা দেশেই সিসা দূষণ ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এর আগে ইউনিসেফ ও আইইডিসিআরের যৌথ গবেষণায়ও দেশের বিভিন্ন জেলায় শিশুদের শরীরে উদ্বেগজনক মাত্রায় সিসার অস্তিত্ব ধরা পড়ে। খুলনা, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী ও সিলেটে ৯৮০ শিশুর মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ঢাকায় ৫০০ শিশুর মধ্যে ৮০ শতাংশের শরীরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত ন্যূনতম মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা পাওয়া যায়।
গত আগস্টে প্রকাশিত গবেষণাটি ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বস্তিতে পরিচালিত হয়। এতে দুই থেকে চার বছর বয়সি শিশুদের রক্তে প্রতি ডেসিলিটারে গড়ে ৬৭ মাইক্রোগ্রাম সিসা পাওয়া গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নির্ধারিত ৩৫ মাইক্রোগ্রামের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সিসার কোনো নিরাপদ মাত্রাই নেই। অল্প পরিমাণও শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।
আইসিডিডিআরবির অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট ডা. জেসমিন সুলতানা জানান, শিশুদের মধ্যে অনেকের রক্তে সিসার মাত্রা ৬৭ মাইক্রোগ্রামের চেয়েও বেশি পাওয়া গেছে। বিশেষ করে সেসব শিশু বেশি ঝুঁকিতে, যাদের বাড়ি সিসানির্ভর শিল্পস্থাপনার এক কিলোমিটারের মধ্যে। এসব শিশুর রক্তে সিসার উপস্থিতি দূরে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি।
সিসার মূল উৎস হিসেবে পুরোনো ব্যাটারি পোড়ানো বা রিসাইক্লিং কারখানা, ধূমপান, দূষিত ধূলিকণা, সিসাযুক্ত প্রসাধনসামগ্রী ও ধাতব রান্নার পাত্রকে চিহ্নিত করা হয় গবেষণায়। পিওর আর্থ নামের একটি সংস্থা ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫টি দেশে গৃহস্থালি পণ্য পরীক্ষা করে। বাংলাদেশের চারটি জেলার বাজার থেকে সংগৃহীত ২৪ শতাংশ নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত সিসা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিক বাসনপত্র, রং, শিশুর খেলনা এবং ভাত/স্টার্চজাতীয় খাবার।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিসা দূষণের কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মোট বুদ্ধিমত্তা সূচক বা আইকিউ প্রায় ২ কোটি পয়েন্ট কমে গেছে। প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হৃদরোগে মারা যাচ্ছে। এই স্বাস্থ্য ক্ষতি দেশের মোট জিডিপির ৬ থেকে ৯ শতাংশ ঘাটতির সমান।
গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে সিসা দূষণে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যায় বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। শিশুদের বিকাশ, প্রাপ্তবয়স্কদের কর্মক্ষমতা এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য এটি এক ভয়াবহ সংকেত। সিসা দূষণ রোধে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা এবং সিসা পোড়ানো শিল্পকারখানা নিরাপদ স্থানে সরানো বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তা না হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।