জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নতুন সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এতে দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে বিশ্বের প্রবালপ্রাচীরগুলো, যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রথম ‘টিপিং পয়েন্ট’ বা সংকটজনক মোড় বলে বর্ণনা করেছেন আন্তর্জাতিক গবেষকরা।
চলতি মাসে প্রকাশিত গ্লোবাল টিপিং পয়েন্টস প্রতিবেদনে ১৬০ জন আন্তর্জাতিক গবেষক জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতিতে নানা অপ্রত্যাবর্তনীয় পরিবর্তন ঘটছে। এই ক্ষতি থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব না। এখনি কার্বন নির্গমন হ্রাস ও টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থার বাস্তবায়নে কার্যকর সিদ্ধান্ত না নিলে প্রকৃতি হয়তো আর কখনো আগের জায়গায় ফিরবে না।
প্রতিবেদন অনুসারে, বন উজাড়ের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা মাত্র ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালেই আমাজন রেইনফরেস্ট ধ্বংসের ঝুঁকিতে পড়বে। একই সঙ্গে, উত্তর ইউরোপের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা আটলান্টিক মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ স্রোতব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু ভারসাম্যের জন্য ভয়াবহ সংকেত। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় ইতোমধ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১.৩ থেকে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২.৩ থেকে ২.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। গত দুই বছর ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর। এই সময়ে সাগরে তাপপ্রবাহের কারণে বিশ্বের ৮৪ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ এই প্রবালপ্রাচীরগুলোই সমুদ্রের প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রাণের আবাসস্থল। বর্তমানে বিদ্যমান নীতিমালার ভিত্তিতে এই শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ৩.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রকৃতিতে এই পরিবর্তনগুলো এত দ্রুত ঘটায় বিস্মিত বিজ্ঞানীরা। তারা প্রবাল পুনরুদ্ধারের জন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমিয়ে শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় কপ-৩০ সম্মেলনে বায়ুমণ্ডলে উষ্ণায়ন সৃষ্টিকারী কার্বন নির্গমন দ্রুত হ্রাস করার উদ্যোগ নিতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আগামী নভেম্বরে ব্রাজিলের আমাজন রেইনফরেস্টে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন- কপ-৩০। এর ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে বিজ্ঞানীদের এই সতর্কবার্তায় নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ব। কপ-৩০ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। প্রশান্ত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়া ও হাওয়াই দ্বীপের মাঝামাঝি নয়টি প্রবালদ্বীপ ও দ্বীপ নিয়ে গঠিত ছোট্ট দেশ টুভালু। নাসার বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে টুভালুর প্রধান প্রবাল দ্বীপ ফুনাফুটির অর্ধেক অংশ সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারে। দেশটির ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা এই দ্বীপে বসবাস করেন। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে চায় দেশটি। ইতোমধ্যে তারা নানা কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে।
টুভালুর জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মাইনা তালিয়া আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, তার দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়ছে। টুভালুর জনগণ যাতে তাদের দেশে থাকতে পারে এ জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বাস্তব প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমাদের দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটার ওপরে। তাই জমি পুনরুদ্ধার, সমুদ্রপ্রাচীর নির্মাণ এবং সহনশীলতা গড়ে তোলা আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। আমরা আর সময় নষ্ট করতে পারি না। টুভালুর বাঁচার জন্য জলবায়ু অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি। এটি এখনই প্রয়োজন যাতে আমরা জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা করতে পারি।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশও। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে দেশের অভ্যন্তরে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। ঝুঁকিতে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। এ ছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল হিসেবে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ছে বাংলাদেশ।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ। অন্যের অপরাধের বোঝা আমরা টানছি। কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে, অথচ জলবায়ু তহবিলের ৯৮ ভাগ অর্থ তারা দেয়নি। যা দিচ্ছে, সেটা ঋণ হিসেবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আরও বিপদে পড়ছে। ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। আগামী ৩০তম জলবায়ু সম্মেলনে আমাদের দাবিগুলো স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। দেশভিত্তিক তহবিল নির্ধারণের দাবি জানাতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের কার্বন ট্যাক্স আরোপ করতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনে এই বার্তা দিতে হবে। এখানে বিদেশিরা এসে দূষণ ঘটিয়ে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে, অথচ কার্বন ট্যাক্স দিচ্ছে না। এসব ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।