বাঙালি যদিও গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নামে পাগল, কিন্তু জাতীয় সংসদকে পুরো মেয়াদ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার জন্য তারা আদৌ মাথা ঘামায় না। জনগণও এ নিয়ে ভাবে না, রাজনৈতিক দলগুলোও ভাবে না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন। দেশের রাজনীতিবিদরা যদি রাজনীতি বুঝতেন, দেশের কল্যাণ কামনা করতেন তাহলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের পরিবর্তে অনুষ্ঠিত হতো ২০৩৩ সালে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে ৬টি সংসদ পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। মেয়াদ পূরণ হোক বা না হোক, বাঙালি নির্বাচন ‘ম্যানিয়াক’ এবং তাদের এ ম্যানিয়ার কারণে তারা ১৯৯৬ সালে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে দ্বিধা করেনি। ছিয়ানব্বইয়ের প্রথম নির্বাচনের আয়ু ছিল মাত্র ১২ দিন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ, যে সংসদ গঠিত হয়েছিল ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদের আয়ু ছিল আট মাসের কম সময়।
ছয়টি জাতীয় সংসদ যে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি, তার পেছনে অন্য যে কোনো পক্ষের চেয়ে রাজনীতিবিদরাই অধিক দায়ী। দেশে দুবার সামরিক আইন জারি এবং একবার বেসামরিক অনির্বাচিত সরকারের পেছনে মদতদানকারী হিসেবে সামরিক বাহিনী ছড়ি ঘোরানোর ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন এই রাজনীতিবিদরাই। ভবিষ্যতে তারা সংসদের মেয়াদ পূরণ করার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটাবেন না, এমন আশা দুরাশা ছাড়া আর কিছু নয়। গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান কিছু রাজনীতিবিদের মাথা বিগড়ে দিয়েছে।
অভ্যুত্থানের সাফল্যের ষোলো আনা দাবি করতে কেউ পিছু হটেনি। এমনকি কোনো কোনো দল এতটাই বেপরোয়া যে তারা আওয়ামী লীগ বিহনে নিজেদের দেশের ক্ষমতায় আসীন দেখতে পাচ্ছে এবং অনুরূপ আচরণ করতে শুরু করেছে। ছোটখাটো দলের নেতারা পর্যন্ত সামরিক বাহিনী এবং সেনাবাহিনী প্রধানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, যা ২০২৪-এর আগে অসম্ভব ছিল। অবাধ স্বাধীনতা যে রাজনীতিবিদদের উন্মত্ত করে তোলে তা এবার আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা উচিত, সেই তালজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন সব ‘দেশপ্রেমিক’ রাজনীতিবিদরা।
‘দেশপ্রেম’-এর প্রকাশ এবং ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় আলোচনায় আছে তিনটি দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। যে কোনো দেশে কোনো অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের সাফল্যের পর সব দল সমন্বয়ে কোয়ালিশন বা জাতীয় সরকার, যদি তা নির্বাচনের মাধ্যমেও হয়, গঠিত হওয়া জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা শুরু থেকেই ঘটেনি। স্বাধীনতা লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সরকার গঠনের পরামর্শের কোনো তোয়াক্কা করেননি। এমনকি তিনি ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ২৯৩টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা নিশ্চিত করেছিলেন। কোনো রাজনৈতিক দল যদি বুঝে যায় যে তাদের ক্ষমতায় আসতে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, তখন তারা আর কোনো দলকে পাত্তা দেয় না। এমনটাই ঘটেছে বিএনপির ক্ষেত্রে। তারা ধরেই নিয়েছে যে তাদের মোকাবিলা করার মতো দ্বিতীয় কোনো দল নেই, তখন তারা তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো জামায়াতকে আক্রমণ করতে যে ভাষায় কথা বলে, বিএনপি এখন জামায়াতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে সেই ভাষা ব্যবহার করছে। বিএনপি এমনকি জামায়াতকে ‘স্বাধীনতার শত্রু’ এবং ‘জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন রাজনৈতিক ভুল ছিল’ মর্মে গালিগালাজ শুরু করেছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে দুই দলের মধ্যে যে দ্বিধা ও ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বৈঠকে বসার জন্য জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ তাহেরের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গিই প্রমাণ করে যে অতীতে জামায়াতের সঙ্গে তাদের মাখামাখি ছিল সম্পূর্ণভাবে তাদেরই স্বার্থে এবং স্বার্থ উদ্ধার করতে তারা তাদের শর্তে জামায়াতকে ব্যবহার করেছে। জামায়াত প্রথমবারের মতো ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে মাতৃদুগ্ধ পানের সুযোগ বঞ্চিত তিন নম্বর ছাগশাবকের মতো লাফালাফি করেছে। তারা এবারও বিএনপির বগলতলায় থেকে ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। কিন্তু বিএনপি মনে করছে যে মাঠে যেহেতু আওয়ামী লীগের মতো ভোট কারচুপি করার কোনো দল নেই, অতএব তাদের পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ ও সরকার গঠন করতে কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই, অতএব অতীতের মতো তারা শুধু জামায়াত নয়, অতীতে তাদের ছোটখাটো মিত্র যারাই ছিল, তাদের প্রতিও কোনোরূপ দৃকপাত করছে না।
সে ক্ষেত্রে জামায়াত কি ভিন্ন কোনো পন্থা অবলম্বন করবে? করতে পারে। কারণ জামায়াত গত বছরের গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে তাদের নেতৃত্ব বলে বিবেচনা করছে এবং শেখ হাসিনার অপনেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতন ও পলায়নের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এবং সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে ঊর্ধ্বতনরা জামায়াতকে যে তমিজ-তোয়াজ করছে, তা জামায়াতকে মানসিকভাবে বলীয়ান করেছে যে তারা এককভাবে নির্বাচন করলেও ক্ষমতায় আসতে তাদের তেমন বাধার মোকাবিলা করতে হবে না। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের ধারণা হলো, অভ্যুত্থানে সাফল্য লাভ এবং নির্বাচনে বিজয় ভিন্ন ব্যাপার। জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে নির্বাচন করেছিল এবং সংসদের ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।
কিন্তু বিজয়ী হয়েছিল মাত্র তিনটি আসনে। বিএনপির প্রতি তাদের যে ক্ষোভ, তা চরিতার্থ করতে তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসার পথ করে দিয়েছিল। তবে ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনে ভরাডুবিও যে জামায়াতের এককভাবে নির্বাচনের অহংকার চূর্ণ করতে পারেনি, তা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রাথমিকভাবে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে ধারণা করা যেতে পারে।
জামায়াতে ইসলামীর জন্য জাতীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র। ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এখানেই বিপত্তি ঘটবে জামায়াতে ইসলামীর। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মোকাবিলায় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো রাজনৈতিক দল নেই।
জামায়াতকে সঙ্গছাড়া করার পেছনে বিএনপির এটাই মূল অভিসন্ধি। এ কথাও সত্য যে নির্বাচনি রাজনীতিতে কোনো দলের পক্ষে আওয়ামী লীগের মতো শঠতার আশ্রয় নেওয়া সম্ভব হবে না।
অতএব অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি যদি এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের মতো আচরণ শুরু করে, তাহলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের আয়ু সংক্ষিপ্ত হতে বাধ্য।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক