বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার শাসনকাল চিরকাল কলঙ্কিতভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এক ভয়াবহ অন্ধকার সময় হিসেবে চিহ্নিত হবে। যেখানে গণতন্ত্র ছিল মুখোশে, উন্নয়ন ছিল কাগজে, আর রাষ্ট্রের প্রতিটি শিরায় প্রবাহিত হয়েছিল ভয়, দুর্নীতি ও প্রতিহিংসা। ২০০৯ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে তিনি ধীরে ধীরে দেশকে রূপান্তর করেন একদলীয় শাসনের ঘাঁটিতে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন- সবকিছু দখল করে নির্মাণ করেন ব্যক্তিনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে জনগণ নয়, শাসকই সর্বেসর্বা।
গণতন্ত্রের প্রাণ হলো- ভোটাধিকার। কিন্তু শেখ হাসিনা এই অধিকারই কেড়ে নিয়েছিলেন জনগণের কাছ থেকে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রকে হত্যা করেন। ২০১৮ সালে রাতের ভোটের মাধ্যমে তার কফিনে শেষ পেরেক ঠুঁকে দেন। ভোট হয় আগের রাতে, কেন্দ্র দখল হয় সরকারি বাহিনীর হাতে, নির্বাচন কমিশন পরিণত হয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। জনগণ ভোট দিতে ভয় পেত। ফল আগেই নির্ধারিত থাকত। এই ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা কার্যত বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেন।
বিরোধী দলের রাজনীতি নির্মূল করতে তিনি প্রয়োগ করেছেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সর্বোচ্চ রূপ। গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, পুলিশি নির্যাতন- এসব হয়ে ওঠে তার শাসনের প্রতিদিনের চিত্র। সংবাদমাধ্যমের ওপর আরোপ করা হয় কঠোর নিয়ন্ত্রণ। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও ভিন্নমতের চিন্তাবিদদের ওপর চলে হয়রানি ও কারা নির্যাতন। প্রশাসন পরিণত হয় এক ভয়াবহ দমনযন্ত্রে, যার একমাত্র কাজ ছিল বিরোধী মতকে চুপ করিয়ে রাখা।
শেখ হাসিনার চালানো দমননীতি সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছে জিয়া পরিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়া পরিবার সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ১/১১-এর অবৈধ সরকার এবং শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালজুড়ে জিয়া পরিবারের ওপর চালানো হয়েছে পরিকল্পিত প্রতিহিংসা। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডের নামে তার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। ইলেকট্রিক শক, ঝুলিয়ে পেটানো, মেঝেতে ফেলে আঘাত করা। যার ফলে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়, হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় এবং তিনি প্রায় পঙ্গুত্বের শিকার হন। এরপর তার বিরুদ্ধে শতাধিক সাজানো মামলা দেওয়া হয়, কিন্তু কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
একই সময়ে বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থেকেও জিয়া পরিবারের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে নির্বাসনে অসুস্থ হয়ে করুণ মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় ৪১ বছরের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে উচ্ছেদ, পরিবারের ওপর প্রশাসনিক হয়রানি এবং তারেক রহমানের বক্তব্য গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ করা- সবই ছিল প্রতিহিংসার অংশ। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির নেতৃত্ব মুছে ফেলা।
অন্যদিকে উন্নয়নের নামে দেশজুড়ে চালানো হয় দুর্নীতির উৎসব। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী, পায়রা, এলএনজি টার্মিনাল- প্রতিটি মেগা প্রকল্পই পরিণত হয় মেগা দুর্নীতির আখড়ায়। কোথাও একটি বালিশের দাম ২৭ হাজার টাকা, কোথাও চুক্তির নামে বিদেশে পাচার কোটি কোটি ডলার। বিদ্যুৎ খাতে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’-এর নামে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা গচ্ছিত হয় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পকেটে। এসব লুণ্ঠনের ফলে দেশ ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় দেড় লাখে। বিদেশে পাচার হয় আনুমানিক ২৩৪ বিলিয়ন ডলার।
রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাটের পাশাপাশি শেখ হাসিনা নিজের পারিবারিক পূজাকেও পরিণত করেন রাষ্ট্রীয় নীতিতে। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং তার ম্যুরাল নির্মাণ প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ব্যয় করা হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। ম্যুরাল, বিলবোর্ড, উৎসব, বিদেশ সফর ও সরকারি প্রচারণায় ছিল সীমাহীন অপচয় ও আত্ম গৌরবের প্রদর্শনী। সরকার ব্যস্ত ছিল নিজেদের প্রচারযজ্ঞে। এ যেন এক ‘মুজিববাদী রাজদরবার’, যেখানে রাষ্ট্রের অর্থ ছিল কেবল ব্যক্তিপূজার পেছনে ঢালার উপকরণ।
শেখ হাসিনার শাসনে স্বজনপ্রীতি ছিল রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ। সরকারি চাকরি, ব্যবসা, ব্যাংক ঋণ, প্রকল্প- সব জায়গায় প্রাধান্য পেয়েছে আওয়ামী লীগের অনুসারীরা। ভিন্ন মতাবলম্বীরা ছিল বঞ্চিত ও হয়রানির শিকার। প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে ওঠে দলীয় ঘাঁটি, আর যোগ্যতার জায়গা দখল করে নেয় দলীয় আনুগত্য। ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার অন্ধ আনুগত্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। তিনি ভারতের স্বার্থ রক্ষায় সব দিয়েছেন- ট্রানজিট, বন্দর, নিরাপত্তা সুবিধা- কিন্তু বাংলাদেশের জন্য কিছুই আদায় করতে পারেননি।
২০১৮ সালের ৩০ মে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে বলেছিলেন- ‘ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে!’ সীমান্তে হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থেকেছে, আর তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের প্রতিশ্রুতি থেকেছে কেবল কাগজে। দেশবাসী দেখেছে কীভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিণত হয় প্রতিবেশী দেশের করুণার উপনিবেশে। ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যও তার শাসনের বড় একটি দিক ছিল। দাড়ি-টুপি পরা ধর্মপ্রাণ মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে, ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সমাজে সৃষ্টি হয় গভীর বিভাজন, যা দেশের দীর্ঘদিনের সহনশীলতা ও সম্প্রীতির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে।
এই দমন, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ফেটে পড়ে তরুণ সমাজ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজপথে নামে। ২০২৪ সালের ৩৬ দিনব্যাপী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষ। আন্দোলন পরিণত হয় এক মরণপণ লড়াইয়ে, যেখানে দেড় হাজারেরও বেশি তরুণ প্রাণ দেন। আহত-পঙ্গু হন প্রায় ২৫ হাজার। তাদের ত্যাগেই জেগে ওঠে জাতি- একই স্লোগানে : স্বৈরাচারের পতন চাই।
অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাঁধভাঙা জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান ভারতে। তার এই পলায়নই নিশ্চিত করে ১৬ বছরের অবৈধ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ শাসনের অবসান। সেই দিন বাংলাদেশ মুক্ত হয় এক স্বৈরশাসকের কবল থেকে। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয় ঘটে।
জুলাইয়ের ভয়াবহ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নির্লজ্জভাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পলায়নের পর তার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানা ও নিম্ন আদালতে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৭৬টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও কয়েক শ মামলা চলমান রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক মামলার মধ্যে তিন শতাধিক অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সুনির্দিষ্টভাবে গৃহীত হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে চলা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনার বিচারকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এ মামলার রায় ঘোষিত হবে ১৩ নভেম্বর। দেশের জনগণ আজ তার বিচারের অপেক্ষায়। কারণ শেখ হাসিনা শুধু একজন ব্যর্থ শাসক নন- তিনি এই জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মানবতার শত্রু। দেশবাসী তার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ