সরকার ঘোষিত নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই বাড়ছে সহিংসতা এবং অবৈধ অস্ত্রের দাপট। জনগণ নির্বাচনমুখী হলেও সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কতটা প্রস্তুত, সে প্রশ্ন উঠেছে। ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। এর ফলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনি আমেজ। কিন্তু এ আমেজে শঙ্কা তৈরি করছে অবৈধ অস্ত্র এবং সন্ত্রাস। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ঘটেছে সহিংসতা। চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগের সময় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন প্রার্থী, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহসহ চারজন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী পূর্ব মসজিদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুলিবর্ষণ ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। তাতে দেখা যায়, এরশাদ উল্লাহ নেতা-কর্মী নিয়ে প্রচারপত্র বিলি করতে করতে এগোচ্ছেন। তাঁর পাশেই ছিলেন সরওয়ার হোসেন। এ সময় হঠাৎ এক যুবক কর্মীদের ভিড়ে ঢুকে পড়ে খুব কাছ থেকে সরওয়ারের ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেন। শুধু এই একটি ঘটনা নয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, নির্বাচনি মাঠ ততই উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়ে গেছে এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সহিংসতায় ১১ জনের মতো নিহত হয়েছে। শুধু অক্টোবরেই নিহত হয়েছে ১০ জন।
আন্তর্জাতিক পরিম লেও বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এখনো নাজুক ও অনিশ্চিত, এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। অক্টোবরের ২০ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় পাঁচ দিনের ‘প্রি-ইলেকশন অ্যাসেসমেন্ট মিশন’ পরিচালনা করে সংস্থাটি। মিশনের পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদনে নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনাস্থা, আইনগত কাঠামোর অসম্পূর্ণতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র বিভাজনের চিত্র উঠে এসেছে।
আইআরআই জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ আন্দোলনের পর ক্ষমতায় আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১১টি কমিশন গঠন করে এবং এসবের সুপারিশ থেকে ৮৪ দফা (জাতীয়) জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হয়।
এ সনদকে ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের নকশা’ হিসেবে দেখা হলেও তা কখন এবং কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপি চায় নির্বাচন শেষে বাস্তবায়ন, ইসলামপন্থি দলগুলো নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি তুলছে। নতুন দলগুলো ‘বাংলাদেশ সংবিধান ২০২৬’ নামে তা নতুন করে অনুমোদনের প্রস্তাব দিয়েছে। আইআরআইয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রকৃত চাবিকাঠি হবে আগামী সংসদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে আইআরআই ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সময়সীমা ও পদ্ধতি স্পষ্ট করা, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো, মনোনয়ন বণ্টনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীদের অনুমোদনে স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক অর্থায়নে জবাবদিহি বাড়ানো। সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশ আশা ও অনিশ্চয়তার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। পরিবর্তনের যে আন্দোলন ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল, তা শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে টেকসই হবে কি না-এখন সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
দেশের পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করেনি। মাঠ প্রশাসনের অবস্থাও নাজুক। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচন বানচালে সক্রিয় একটি শক্তি। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার এসব বাস্তবতা অস্বীকার করছে না। সরকার সব প্রতিকূলতা জয় করে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলেও সেখানে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন ওই নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে না, তেমন অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই নির্বাচন করলেই হবে না, তা অবশ্যই হতে হবে অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য। আর এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সবচেয়ে জরুরি। আর সেটা করতে হলে অবশ্যই সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা দরকার। বাংলাদেশের সব সংকটেই সশস্ত্র বাহিনী জাতির ত্রাতা হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা সব সময় অপরিসীম ছিল। সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া বাংলাদেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়নি। আশার কথা আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনী ইতোমধ্যে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছে।
৫ নভেম্বর দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে (এ) অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের আগামী নির্বাচন নিয়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সেনা সদর দপ্তরের আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (জিওসি আর্টডক) জেনারেল অফিসার কমান্ডিং লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান। ব্রিফিংয়ে আরও দুজন সেনা কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। তাঁরা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সেনা কর্মকর্তা দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সবাইকে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় করেছে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের সহায়তা দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবে সেনাবাহিনী।’
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর হোসেন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানরা সাক্ষাৎ করেছেন। আলোচনার বিষয়বস্তু ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা যাতে স্বাভাবিক থাকে সে লক্ষ্যে সেনাবাহিনী কাজ করতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের সময় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনাসদস্য মাঠে মোতায়েন থাকবে। এটি এযাবৎকালে সর্বোচ্চ। সেনাবাহিনীর পরিকল্পনায় রয়েছে জেলা, উপজেলা এমনকি আসনভিত্তিক ক্যাম্প স্থাপন করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করার জন্য যা যা প্রয়োজন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তা করতে প্রস্তুত।’
আগামী জাতীয় নির্বাচনে আমাদের গৌরবের সশস্ত্র বাহিনী জনগণের আশাভরসার জায়গা। দেশের মানুষ মনে করে, শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর বলিষ্ঠ ভূমিকা একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করবে। এজন্য নাগরিক হিসেবে জনগণকে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে নানানরকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বুধবারের ব্রিফিংয়ে এ প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়েছিল। সেখানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান বলেন, ‘আমরাও লক্ষ করেছি যে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সেনাবাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই যে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য সেনাবাহিনীর প্রধান, সেনাবাহিনীর সিনিয়র লিডারশিপের (জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব) প্রতি শতভাগ অনুগত এবং বিশ্বস্ত রয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সেনাবাহিনী এখন আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ এবং আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ এখন আরও বেশি। সমাজমাধ্যমে যে প্রচারণা, এটাকে আমরা পরিহার করে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।’
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান বলেন, ‘সমাজমাধ্যমের প্রচারণার (নেতিবাচক) বিরুদ্ধে কিছু করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ সেনাবাহিনীর নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। সেনাবাহিনী কী করছে, সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ থাকে। মিথ্যা বিতাড়িত করার জন্য সত্যই যথেষ্ট। সত্যের মাধ্যমে এবং কাজের মাধ্যমে সেটার প্রমাণ করতে চায় সেনাবাহিনী।’
আমরা জানি ২০২৪-এর গণ অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল সেনাবাহিনীর সাহসী এবং সময়োচিত সিদ্ধান্তের কারণে। সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জন্যই জনগণের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হওয়া পর্যন্ত সরকারবিহীন অবস্থায় দেশ এবং জনগণকে আগলে রেখেছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যরাই। ১৬ মাস ধরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেটুকু স্বাভাবিক আছে তার পুরোটা কৃতিত্ব আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর। দেশজুড়ে মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীই আশাভরসার একমাত্র জায়গা। মাঠে সশস্ত্র বাহিনী না থাকলে দেশবাসী যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতো তা ভাবলেও আতঙ্কিত হতে হয়। আমাদের তাই দায়িত্ব হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখা। ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সহযোগিতা করা। জাতির ঐক্যের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা। আমাদের বুঝতে হবে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই পারে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে। আর একটি ভালো নির্বাচনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীই আমাদের শেষ ভরসা।