বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছুদিন আছে, যেগুলো কেবল একেকটি তারিখ নয়, বরং একেকটি মাহেন্দ্রক্ষণ, একেকটি নবযুগের সূচনা। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেই রকম ঐতিহাসিক দিন, একটি বিপ্লব, একটি ঐক্য এবং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের নিরিখে পুনরায় এক পথচলা। ইতিহাসে এই দিনটি চিহ্নিত হয়েছে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে, যেদিন দেশের সেনা ও সাধারণ মানুষ একই পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এটি ছিল এমন এক বাস্তবতা, যা রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের সীমা ছাড়িয়ে এক পুনর্জাগরণের প্রতীক হয়ে ওঠে।
৭ নভেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতা, বিভাজন আর বিদেশি প্রভাবমুক্তির আহবান, একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের মনোজাগতিক প্রেক্ষাপট।
শেখ মুজিবের বাকশালকেন্দ্রিক একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে অনিয়ন্ত্রিত ও মারাত্মক রূপ ধারণ করে এবং বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে নিক্ষেপ করে। দেশ তখন নেতৃত্বশূন্য, সেনাবাহিনী বিভক্ত আর জনগণ দিশাহারা। এই প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব ছিল আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের এক নবপ্রয়াস।
বন্দি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুক্তি এবং তাঁর নেতৃত্বে জনগণ ও সেনাবাহিনীর ঐক্য—এই দুই ঘটনার মিথস্ক্রিয়ায় জন্ম নেয় নতুন বাংলাদেশ। এই দিনটি প্রমাণ করে, জাতির ভাগ্য কোনো বিদেশি দূতাবাস বা গোষ্ঠীর হাতে নয়, বরং জনগণের ইচ্ছা ও ঐক্যের ভেতর নিহিত। সেদিনের সেই ঐক্য আজও শেখায়, যে জাতি নিজের মুক্তির দায়িত্ব নিজে নেয়, তাকে কেউ পরাজিত করতে পারে না।
৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশ নতুন এক আদর্শের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পথে যাত্রা শুরু করে।
এটি কেবল একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব ছিল না, বরং ছিল জাতির আত্মপরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ঘোষিত ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভূখণ্ড নির্ভর এক সমন্বিত জাতিসত্তা গঠন করে। তাঁর ঘোষণা ছিল সুস্পষ্ট : ‘আমরা প্রথমে বাংলাদেশি, তারপর মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান।’ এই বক্তব্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল এক বাস্তববাদী ঐক্যে নির্ভর দর্শন, যা বিদেশি মতাদর্শের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রে রূপান্তর করেছিল। এটি ছিল এক দৃঢ় প্রত্যয়, বাংলাদেশ আর কারো ছায়ায় নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজস্ব নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্বে নিজের অবস্থান গড়ে তুলবে।
এই সময়েই সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বুঝেছিলেন, একটি রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে বাহিনীকে পেশাদার, দেশপ্রেমিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে। তিনি সেনাবাহিনীতে নতুন কাঠামো ও নীতিনির্ধারণ করেন, যেখানে সেনাবাহিনীকে জনগণের রক্ষক এবং রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে দেখা হয়। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী আবারও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্ভাসিত হয়, আর বিভক্ত মনোবল পরবর্তী সময়ে ঐক্য ও শৃঙ্খলার প্রতীকে রূপ পরিগ্রহ করে। তাঁর সময়েই গঠিত হয় জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি, যা অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক ভারসাম্যের মধ্যে এক কৌশলগত সেতুবন্ধ তৈরি করে। এই সময় থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি সামরিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধই সর্বোচ্চ নীতি বলে বিবেচিত হয়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন সেই বিরল সামরিক নেতা, যিনি ক্ষমতা ধরে রাখার বদলে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সামরিক প্রশাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে রূপান্তরের যে পথ তিনি নির্দেশ করেন, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ও অনন্য। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং জনগণকে তাদের মত প্রকাশের সুযোগ দেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৭৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রাণ ফিরে পায়। তাঁর নেতৃত্বেই গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি একটি আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন, যার মূলে ছিল গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন এবং ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের সমন্বয়।
৭ নভেম্বরের পর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের দিকেও মনোনিবেশ করেন। তাঁর ঘোষিত ‘গ্রাম হবে শহর’ নীতি ছিল রাষ্ট্রচিন্তার এক যুগান্তকারী প্রয়োগ, যেখানে উন্নয়নকে কেন্দ্রীয় শহরনির্ভর না রেখে বিকেন্দ্রীভূত করা হয়। তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও সমবায়ভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করেন, যাতে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের উন্নয়নে সরাসরি অংশ নিতে পারে। তিনি কর্মসংস্থান, কৃষি উন্নয়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মনির্ভর অর্থনীতি গঠনের আহবান জানান।
পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতিতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অনুসরণ করেন ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’—এই বাস্তববাদী নীতি, যা বাংলাদেশের স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থানকে বিশ্বমঞ্চে সুদৃঢ় করে তোলে।
৭ নভেম্বর ছিল ষড়যন্ত্রের অবসান এবং আত্মমর্যাদার পুনর্জাগরণ। এই দিনটি জাতিকে শিখিয়েছে, বাংলাদেশের ভাগ্য বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করতে পারে, কোনো বিদেশি শক্তি নয়। এদিন সিপাহি-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রমাণ করেছে, দেশের স্বাধীনতা কেবল অস্ত্রের শক্তিতে নয়, বরং ঐক্য, বিশ্বাস ও দেশপ্রেমের শক্তির ভিত্তিতে টিকে থাকে। এটি এমন এক ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা বিভাজনের রাজনীতি ও বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রতিধ্বনি হয়ে আজও আমাদের কানে বাজে।
এই ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরের চেতনা পুনরুজ্জীবিত হয় ২০২৪ সালের অগ্নিঝরা আগস্ট মাসে জনগণ-সেনা ঐক্যের মধ্য দিয়ে, যখন দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একযোগে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-নিপীড়ন, অন্যায় ও বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ৭ নভেম্বরের মতোই আজও সেনা ও জনতার ঐক্যই দেশের অস্তিত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। ঐতিহাসিক নভেম্বর এবং দেদীপ্যমান জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম প্রমাণ করেছে যে জাতির সার্বভৌমত্ব কেবল কোনো রাজনৈতিক দলের হাতে নয়, বরং জনগণের সম্মিলিত চেতনায় নিহিত। যেমন ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে একটি বিভক্ত রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, তেমনি চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঐতিহাসিক ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পুনরায় জাতির আত্মমর্যাদা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছে। এই দুই ঘটনার মাঝে প্রায় অর্ধশতাব্দীর ব্যবধান, কিন্তু তাদের মূলে একই দর্শন—বাংলাদেশ নিজের ভাগ্য নিজেই নির্ধারণ করবে, কোনো পরাশক্তির ছায়ায় বাংলাদেশের গতিপথ নির্ধারিত হতে পারে না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বরের চেতনা তাই আরো গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজ যখন দেশের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র ও জাতীয় সংহতি প্রশ্নবিদ্ধ; যখন বিদেশি প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য টলমল; তখন ৭ নভেম্বরের শিক্ষা আমাদের নতুন করে পথ দেখায়। এই দিনের মর্মবাণী হলো জাতির শক্তি জনগণের ঐক্যে, সৈনিকের দেশপ্রেমে, আর নেতৃত্বের সততায়। ৭ নভেম্বর শেখায়, দেশপ্রেম মানে কোনো দলের প্রতি আনুগত্য নয়, বরং জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকার। এটি আরো শেখায়, সেনা ও জনতার ঐক্যই পারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য ৭ নভেম্বর শুধু অতীতের স্মৃতিচারণা মাত্র নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের একটি দিকনির্দেশনা। সেদিনের সিপাহি-জনতার বিপ্লব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জাতীয়তাবাদ মানে হলো আত্মমর্যাদা; গণতন্ত্র হলো আপামর জনতার অংশগ্রহণ; আর দেশপ্রেম হলো দায়িত্ব, ত্যাগ ও সাহসের সম্মিলন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এই বার্তাটিকেই পুনরুজ্জীবিত করেছে। ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি করেছে এমনভাবে, যেখানে স্বাধীনতার চেতনা আবারও জনতার হাতে ফিরে এসেছে এবং সেই চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ৭ নভেম্বরের সেই অমর ঐক্যের স্মারক।
নিকট অতীতে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে জাতি ৭ নভেম্বরের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল বলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। ৭ নভেম্বরের ঐক্য, সাহস ও আত্মমর্যাদাকে ধারণ করে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন রক্ষা করেছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। সেদিনের সিপাহি-জনতার বিপ্লব আজও আমাদের আত্মিক শক্তির ফল্গুধারা এবং আমাদের জাতীয় পুনর্জাগরণের আলোকবর্তিকা ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক