চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির বিষয়টি বহুদিন ধরে আলোচনায়। কিন্তু ব্যবস্থাপনার উন্নতিসহ চট্টগ্রাম বন্দরের মান উন্নয়নে কোনো উদ্যোগের একটি খবরও দিতে পারেনি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। এর বদলে দিতে পারছে বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দেওয়ার সদরে-অন্দরে নানা আয়োজনের খবর। এটি যেনতেন বিষয়? আদৌ কোনো অন্তর্বর্তী, মধ্যবর্তী বা অস্থায়ী সরকারের কাজ? বরাবরই সমুদ্রবন্দর বিষয়ে ড. ইউনূসের একটি আলাদা নজর রয়েছে।
বন্দরগুলোর বিশ্বগুরুত্ব বোঝার প্রশ্নে তিনি উচ্চমার্গের মানুষ। তাই অনেকের আশা ছিল, তাঁর হাত দিয়ে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলো ভিন্ন অবয়বসহ বাড়তি গুরুত্ব পাবে। বিশ্বের কাছে প্রেজেন্টেবল হবে। কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা।
মানোন্নয়ন দূরে থাক, বন্দরের নিজস্বতাই দেশের হাতছাড়া করে দেওয়ার আয়োজন পাকাপোক্ত হচ্ছে। কেমন হয়ে গেল ব্যাপারটা? সাধারণ মানুষের ধারণারও বাইরে।
এ সরকারের ফরজ কাজের অন্যতম হচ্ছে নির্বাচন করা। সঙ্গে নফল বা বাড়তি কাজ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যবস্থাপনা- দুর্নীতি-অনিয়মের একটা হিল্লা করতে পারত। তা না করে ‘এটা বিদেশিদের দিয়ে দাও’ পথ বাছাই করা হচ্ছে। আমাদের সচিবালয়, সংসদ, এমনকি আদালতেও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা রয়েছে। কখনো কখনো প্রোডাক্টিভিটি থাকে না। সরকারের বিভিন্ন অফিসেও দুর্নীতি হয়, হচ্ছে। এখন সেগুলো হ্যান্ডেলিংয়ের ভারও বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে হবে? মূল ফের অন্যখানে।
আসলে চট্টগ্রাম বন্দর লাভজনক। সেই লাভের গুড়ে নজর বিদেশিদেরও। অজুহাত হিসেবে বলার চেষ্টা করা হয়, অনেক দেশ তো বিদেশিদের কাছে ইজারা দিয়েছে।
কিন্তু সেসব দেশের বন্দরের সংখ্যা কত জানা আছে? কয়টা বন্দরের মধ্যে কয়টা ইজারা দিয়েছে? আমাদের বন্দর কয়টা? এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে কি বন্দর কোনো সাবজেক্ট হতে পারে? হওয়া উচিত? মানুষ চায় নির্বাচনী উদ্যোগ দৃশ্যমান হোক। কিন্তু সরকার তার কাজের পেরিফেরি নিয়ে যাচ্ছে আরেকদিকে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৯টি দেশের মধ্যে সমুদ্রবন্দরে আমদানি পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শেষ করতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে পাকিস্তানে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। এ কারণে আমদানিকারকরা তাঁদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমদানি করা পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেন।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তারা। দেশের বেশির ভাগ পণ্যের আমদানি-রপ্তানি হয় এ বন্দর দিয়ে। চলমান কাজের অংশ হিসেবে সরকার চাইলে বন্দরের অব্যবস্থাপনা দূর করার একটি উদ্যোগ নিতে পারত। সম্ভব ছিল বন্দরের গতিশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া। পাশাপাশি সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে চোখ দেওয়া। তা না করে কুটিল ও বাঁকাপথে হাঁটার প্রবণতা।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং বৃহত্তম বন্দর। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ কনটেইনার এবং ৯৩ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। যে কারণে আরো দুটি সমুদ্রবন্দর থাকার পরও এটি বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বন্দর নয়, এটি বাংলাদেশের সম্ভাবনার পরীক্ষার ক্ষেত্র। বিষয়বস্তু না হলেও গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরে এ বন্দর বারবার আলোচনায় এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ব্যবস্থাপনা বিদেশি কম্পানিকে দেওয়া নিয়ে কথাগুলো কখনো কখনো কথার কথা থাকছে না, হয়ে যাচ্ছে অতিকথা, কুকথা। কেন এটিকে এ সময় কথামালায় আনা হবে? আমাদের তিনদিক ভারত দিয়ে ঘেরা, আর একদিকে সমুদ্র। বিশ্বে সমুদ্র না থাকা দেশগুলোকে বলা হয় অভাগা। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ভাগ্যবান। কিন্তু সমুদ্র থেকেও তার নিয়ন্ত্রণ না থাকা প্রকারান্তরে দুর্ভাগ্য। সমুদ্র এবং তার ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বা এনসিটি। দেশের মোট কনটেইনার পণ্য ওঠানামার ৫৫ শতাংশই হয় এনসিটি দিয়ে। পণ্য ওঠানামার আধুনিক সব উপকরণ ও যন্ত্রপাতি রয়েছে এই টার্মিনালে।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম এই টার্মিনাল থেকে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গেল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। এ সরকারও কেন সেই পথ মাড়াচ্ছে? নিষ্পত্তিহীন প্রশ্ন। বিষয়টি স্পর্শকাতরও। এর বিরুদ্ধে বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীসহ অনেকেই প্রতিবাদমুখর। এর পরও চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা ও টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে সরকার যত উতলা হবে, সরকারের মোটিভ নিয়ে তত প্রশ্ন উঠবে। রাষ্ট্র এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার মনে করলে সেটি ভাবার এখতিয়ার রাখে নির্বাচিত সরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নির্বাচন, সংস্কার, মানবাধিকারের বিচারসহ কত কাজ। সরকারের হাতে সময়ও আছে বড়জোর মাস চারেক। এ রকম সময় কেন বন্দরের হ্যান্ডেলিংয়ে হ্যান্ডেল মারতে যাওয়া?
কয়েক দিন আগে সরকারের দিক থেকে জানানো হয়েছে, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বন্দর ঘিরে মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। তরুণদের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হলে শুধু দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য নয়, পুরো রিজিয়নের ৩০ থেকে ৪০ কোটি মানুষ এর সুফল ভোগ করবে। চট্টগ্রামের লালদিয়া, বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরসহ পুরো অঞ্চলটাই বন্দরের উপযোগী। মানুষ কি এ সময় এসব শুনতে চায়? বা শুনতে হবে বলে ধারণাও ছিল? ফরজে ঠন ঠন, নফলে ঠেলাঠেলি বলতে গ্রামবাংলায় বহু পুরনো একটা স্লোক আছে। এর নতুন ভারসন দেখতে হচ্ছে বন্দর ঘিরে সরকারের অতি কাজে। বন্দরের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও যুক্ত। তাই বন্দর নিয়ে যাই করা হোক, চিন্তা-ভাবনার বিষয় রয়েছে। কেউ কেউ বলতে চান, বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া এখন বৈশ্বিক ট্রেন্ড। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় বন্দর পরিচালিত হয়। কোনো বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আনা হয় দুটি কারণে। এর একটি হলো নিজেদের পুঁজি না থাকায় বিনিয়োগ পাওয়া, আর অন্যটি হলো উন্নত যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ কর্মীর সঙ্গে থেকে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি। কিন্তু নিউমুরিং টার্মিনালে নতুন করে এসব খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। কারণ পাশেই নৌঘাঁটি থাকায় এটি সুযোগ নেই সম্প্রসারণের। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কেন এই উৎসাহ? পৃথিবীর যেসব দেশের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে, সেই দেশগুলোতে বন্দর কতগুলো? ভিয়েতনামে বন্দর আছে ২৯৬টি। তার মধ্যে হাইফং, কাই মেপ-থি ভাই এবং সাইগন বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি কনটেইনার বন্দরের অন্যতম। শ্রীলঙ্কায় আটি বন্দর, পাকিস্তানে ৩৭টি বন্দর, যার মধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর, ভারতে ২৩০টি বন্দর, যার মধ্যে ১২টি প্রধান বন্দর, যেগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়। ভারতের এই বন্দরগুলোর মাধ্যমে সে দেশের ৯৫ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ কি এসব দেশের মতো? যে দেশের শিল্পের কাঁচামাল পুরোটাই আমদানিনির্ভর, জ্বালানির ওপর বিদেশি নির্ভরতা বেশি, রপ্তানির ৮০ শতাংশ গার্মেন্টস পণ্য, খাদ্য এবং ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়, সেই দেশ তার একমাত্র বন্দর নিয়ে ঝুঁকি নিতে পারে?
পাশাপাশি এই ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক বিষয়টাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে আরো কথা আছে। যে পোর্ট বা টার্মিনালে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি, সেখানে বিনিয়োগ করা হয়, যাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ দিয়ে পোর্ট বা টার্মিনাল তৈরি করতে পারে। এরপর তারা সেটি পরিচালনা করে তাদের বিনিয়োগ তুলে নেবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর বিদেশিরা চলে যাবে। তখন বন্দর আবার দেশীয় মালিকানায় ফিরে আসবে। কিন্তু নিউমুরিং পুরোদমে চলমান একটি টার্মিনাল। এখানে বিদেশি বিনিয়োগ কেন প্রয়োজন, কোথায় প্রয়োজন এবং এর ফলে বন্দরের দক্ষতা কতটা বাড়বে সেটা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা দরকার। সেটা করার এখতিয়ারও নির্বাচিত সরকারের। গত সোয়া এক বছরে বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিপুল সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে শুধু ফরজ বাদ দিয়ে নফল নিয়ে ঠেলাঠেলি আর নানা মতলববাজিতে। নানা শঙ্কা-সংশয় কাটিয়ে দেশে বর্তমানে নির্বাচনের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। সেখানে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই মাহেন্দ্রক্ষণে কারোরই হঠকারিতা-ধড়িবাজির অবকাশ থাকা ঠিক নয়। কেউ গণ-অভ্যুত্থানের তাৎপর্য উপলব্ধিতে না নিয়ে অন্য কিছুতে মেতে থাকলে শত শত শহীদের আত্মা ও হাজারো আহতের অভিশাপ অবধারিত।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিডি প্রতিদিন/নাজিম