চট্টগ্রামের সামুদ্রিক ও উপকূলীয় পানিতে পাওয়া এক ধরনের মাছ সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ এবং কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। এই মাছটি পানির নিচে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে! স্থানীয় জেলেরা একে কখনো ‘জলের ভূত’, আবার কেউ কেউ ‘ছায়া মাছ’ বলে ডাকেন। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি যেমন চমকপ্রদ, তেমনি প্রকৃতির এক অনন্য অভিযোজনের নিদর্শন।
এই মাছটির শরীর এবং ত্বকের গঠন এমনভাবে তৈরি যে, এটি চারপাশের পানির প্রতিফলন ও প্রতিসরণ নিখুঁতভাবে অনুকরণ করতে পারে। এর দেহে গুয়ানিন ক্রিস্টাল নামক এক ধরনের অণুস্তর রয়েছে, যা আলোকে বিশেষ কোণে প্রতিফলিত করে মাছের শরীরকে প্রায় স্বচ্ছ করে তোলে। ফলে মাছটি যখন পানির নিচে থাকে, তখন আশপাশের আলো ও পানির প্রতিফলন তার শরীরে এমনভাবে পড়ে যে, এটি প্রায় অদৃশ্য মনে হয়।
এই অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা আসলে এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক কৌশল। সমুদ্রে বড় শিকারি মাছ বা পাখিদের চোখ এড়াতে এই মাছের স্বচ্ছতা কার্যকর ভূমিকা রাখে। জলীয় স্তরের নিচে ভেসে থাকলে এটি আলোর দিক অনুযায়ী নিজের শরীরের প্রতিফলন সামঞ্জস্য করে, যেন তার ছায়াও পানির ভিতর হারিয়ে যায়। গবেষকরা ধারণা করছেন, এই মাছটি ইন্দো-প্যাসিফিক গ্লাস ফিশ বা তার কাছাকাছি কোনো প্রজাতির হতে পারে। এ ধরনের মাছকে সাধারণত ‘গ্লাস ফিশ’ বলা হয়। কারণ তাদের দেহ এতটাই স্বচ্ছ যে অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গও চোখে পড়ে। তবে চট্টগ্রামের উপকূলে পাওয়া মাছটির আচরণ ও রং পরিবর্তনের ক্ষমতা গ্লাস ফিশের তুলনায় আরও উন্নত, যা স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের ফল বলে মনে করা হচ্ছে।
এই মাছের অদৃশ্য হওয়ার প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে বায়োমিমেটিক প্রযুক্তি বা অদৃশ্য পোশাক তৈরির গবেষণায় অনুপ্রেরণা দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখন এই মাছের ত্বকে উপস্থিত আলো প্রতিফলনকারী ন্যানো-গঠন বিশ্লেষণ করছেন, যা একদিন মানবপ্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হতে পারে।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় সামুদ্রিক অঞ্চলে শিল্পবর্জ্য, জাহাজ ভাঙা ও প্লাস্টিক দূষণের কারণে এই অনন্য প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়ছে। দ্রুত সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এই ‘অদৃশ্য মাছ’ প্রকৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়