দ্রুত বদলাচ্ছে ফ্যাশন। আজকের ফ্যাশন ট্রেন্ড কিছুদিনের মধ্যেই পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। নতুন ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মেলাতে আমরা ঘন ঘন নতুন পোশাক কিনছি, পুরোনোটা দ্রুত বদলে ফেলছি। একই পোশাক একাধিক অনুষ্ঠানে না পরার প্রবণতা, বিভিন্ন দিবসভিত্তিক নতুন ডিজাইন- সব মিলিয়ে পোশাক কেনা ও বদলানোর এই অভ্যাস পরিবেশের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, ফ্যাশন শুধু নিজের সৌন্দর্য প্রকাশের মাধ্যম নয়, এটি হতে পারে পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের উপায়ও। পোশাকের দায়িত্বশীল ব্যবহারে ফ্যাশন হয়ে উঠতে পারে পৃথিবী বাঁচানোর ভাষা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিনির্ভর শিল্প হলো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। পোশাক তৈরি, রং করা, পরিবহন- প্রতিটি ধাপে লাগে প্রচুর বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি ও রাসায়নিক। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত বিভিন্ন গবেষণা ও পরিবেশসংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এক জোড়া ডেনিম (জিন্স) প্যান্ট তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায়- বিশেষ করে কটন উৎপাদন, ফেব্রিক প্রস্তুত, রং করা ও ওয়াশিংসহ মোট পানি লাগে ৭ থেকে ১০ হাজার লিটার। শুধু ওয়াশিং প্রক্রিয়ায় লাগে ৫০-১০০ লিটার (প্রথাগত পদ্ধতি)। উন্নত লেজার ওয়াশ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পানি খরচ হয় ১৫-২০ লিটার, যে প্রযুক্তি সব কারখানায় নেই। দূষণের কারণে নদনদীর পানি ব্যবহার উপযোগী না থাকায় বাংলাদেশে এই পানির অধিকাংশ জোগান আসে ভূগর্ভস্থ হতে। এতে ক্রমেই ভূগর্ভের পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, যা পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া পোশাকে পলিয়েস্টারসহ নানা কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারও বাড়াচ্ছে পরিবেশদূষণ। অনেক কাপড় মাটিতে ফেলে রাখলে পলিথিনের মতোই দীর্ঘদিন নষ্ট হচ্ছে না। ফাস্ট ফ্যাশনের (ঘন ঘন বদল) ফলে বছরে কোটি কোটি পোশাক আবর্জনায় পরিণত হচ্ছে, যা কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। আমরা পোশাক কেনা, ধোয়া ও ব্যবহার করার অভ্যাসে সামান্য পরিবর্তন আনতে পারলে তা পৃথিবীর শক্তি ভারসাম্যে ও দূষণ কমাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভোগবাদ আজ পৃথিবীর নীরব সংকট। ফ্যাশন, গ্যাজেট, ভোগের প্রতিযোগিতা বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশের ধ্বংস। অনিয়ন্ত্রিত ভোগবাদী মানসিকতা কমাতে দরকার সচেতন ভোক্তা সংস্কৃতি, ‘কম কিনুন, ভালো ব্যবহার করুন, পুনঃব্যবহার করুন’ এ নীতিতে অভ্যস্ত হওয়া। শিক্ষা, গণমাধ্যম ও নীতি- প্রণয়নে টেকসই জীবনধারাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে এটি শুধু সম্ভব নয়, প্রয়োজনও বটে, কারণ আমাদের পরিবেশগত দূষণ ইতিমধ্যেই চরমে পৌঁছেছে। স্থায়িত্বশীল, প্রকৃতিবান্ধব পণ্য ও সেবা হতে হবে আগামী সময়ের নতুন ফ্যাশন। মনে রাখতে হবে- ভোগ কিছুটা কমালেন মানে আপনি পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখলেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করতেই প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক শাসন দরকার।
এদিকে ভোগ ও পরিবেশের এই মুখোমুখি অবস্থান সারা পৃথিবীতে এখন অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ফলে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখন টেকশই ফ্যাশনে ঝুঁকছে। শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এক গবেষণায় দেখতে পায়, একজোড়া জিনস তৈরিতে ৭ হাজার লিটার পানি ব্যয় হয়- যা একজন ব্যক্তির সাত বছরের খাবার পানীর চাহিদা মেটাতে পারে। এরপরই প্রতিষ্ঠানটি পানির অপচয় রোধে মনোনিবেশ করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ১ কোটি ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৪৮৬ ঘনমিটার পানি পুনর্ব্যবহার করে, যা ৭ হাজার ২৮৮টি অলিম্পিক সুইমিং পুলের পানির সমান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি পর্যায় থেকে সচেতন হতে হবে। পোশাকে দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দূষণ ও শক্তি অপচয় অনেকটাই কমানো সম্ভব। কটন, লিনেন, জুট বা বাঁশের তন্তুর মতো প্রাকৃতিক কাপড়ের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এগুলো তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে শক্তি খরচ কম হয়। এগুলো সহজে পচনশীল। রিসাইকেল করা ফেব্রিকও পরিবেশবান্ধব। স্থানীয় ব্র্যান্ড বা হস্তশিল্পের পোশাক কিনলে একদিকে পরিবহন খরচ কমে, অন্যদিকে স্থানীয় অর্থনীতি লাভবান হয়। এ ছাড়া পুরোনো পোশাক নতুনভাবে ব্যবহার- অর্থাৎ আপসাইক্লিং এখন নতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড। পুরোনো জিনসের প্যান্ট ফেলে না দিয়ে তা দিয়ে ব্যাগ তৈরি করে ফেলছে। এদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ফ্যাশন হাউস এখন রিসাইকেল ফেব্রিক, প্রাকৃতিক রং ও সোলার এনার্জির ব্যবহার বাড়াচ্ছে। ফলে ফ্যাশন শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, পরিবেশ রক্ষার প্রতীক হিসেবেও গুরুত্ব পাচ্ছে। ফেলে দেওয়া কাপড় নতুন ডিজাইনে আবার ব্যবহার করা পরিবেশ সচেতনতার একটি ইতিবাচক উদাহরণ। একই পোশাক বিভিন্নভাবে পরা বা একাধিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারও পোশাকের টেকসই ব্যবহার, যা পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে। তাদের মতে, শক্তি সঞ্চয় ও পরিবেশ রক্ষার যাত্রা শুরু হতে পারে আমাদের পোশাকের আলমারি থেকেই। স্টাইলিশ হওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনি সচেতন হওয়া সময়ের দাবি। কারণ, দায়িত্বশীল ফ্যাশনই ভবিষ্যতের টেকসই পৃথিবীর পথ দেখাবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের (পরিজা) সভাপতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, ভোগ এখন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। স্কুলগামী শিক্ষার্থীর কাছে লাখ টাকার মোবাইল ফোন। কে কোন ব্র্যান্ডের পোশাক পরছে, কত বেশি নতুন পোশাক কিনছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। এটা ওই পরিবারের অর্থনীতিতে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, জাতীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। শক্তির অপচয় বাড়াচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতি করছে। অতিরিক্ত ভোগের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দুর্নীতিও বাড়ছে। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো ভোক্তার মনস্তত্ত্বের ওপর গবেষণা করে কিছুদিন পর পর নতুন মডেল/ফ্যাশন বাজারে হাজির করে। বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন শো- এমন নানা পদ্ধতিতে তা ভোক্তার কাছে অপরিহার্য করে তোলে। সেই ফাঁদে আমরা পা দেই। একমাত্র সচেতনতাই এখান থেকে মুক্তি দিতে পারে।