কৌতুক হচ্ছে চলচ্চিত্রের প্রধান প্রাণরস। ঢাকাই চলচ্চিত্রের সূচনালগ্ন থেকে কৌতুক অভিনেতারা তাঁদের সুঅভিনয় দিয়ে দর্শকদের বিনোদিত করে আসছেন। চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকজন কৌতুক অভিনেতার কথা এখানে তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
সাইফুদ্দিন
কৌতুক অভিনেতা সাইফুদ্দিন ঢাকার প্রথম সবাক বাংলা ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬)-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ষাটের দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত চলচ্চিত্রে নিয়মিত ছিলেন। এ সময় তিনি প্রায় ৪০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে- মুখ ও মুখোশ, চাওয়া-পাওয়া, আঁকাবাঁকা, ময়নামতি, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, জল ছবি, মধু মিলন, বধূ বিদায়, আরাধনা, সুন্দরী, শহর থেকে দূরে, শেষ উত্তর, বড় ভালো লোক ছিল, চন্দ্রনাথ, দহন ও বেদের মেয়ে জোসনা উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৯ সালে সুন্দরী ছবির জন্য সেরা পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
খান জয়নুল
১৯৬৬ সালে ‘১৩ নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবির মাধ্যমে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে বড় পর্দায় আসেন খান জয়নুল। নাচের পুতুল সিনেমায় বাবুগিরি করে বেড়ানো নায়িকার ছোট ভাই, ছন্দ হারিয়ে গেল- তে সেই অর্থকষ্টে থাকা অথচ প্রফুল্ল বন্ধু, ‘অবুঝ মন’-এর কম্পাউন্ডার ইত্যাদি চরিত্রগুলোতে লাফালাফি-ঝাপাঝাপি না করে শুধু ভ্রু আর মুখের ভাঁজের অনবদ্য অভিনয় দিয়ে প্রচণ্ড হাস্যমুখর পরিবেশ তৈরি করতে পারার অসামান্য ক্ষমতা তাঁর। ১৯৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি না ফেরার দেশে চলে যান এ কৌতুক অভিনেতা।
আশীষ কুমার লৌহ
বিশিষ্ট নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, লেখক, অভিনেতা ও কৌতুক অভিনেতা আশীষ কুমার লৌহ। ১৯৬১ সালে ‘হারানো দিন’ ছবির মাধ্যমে বড় পর্দার অভিনয়ে আসেন তিনি। ১৯৫৫ সালে বিভিন্ন মঞ্চনাটকে অভিনয় ও কৌতুক প্রদর্শন করে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। এ সময় তিনি বেতার ও টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত অভিনয়শিল্পী হয়ে যান। শিল্পী হিসেবে তিনি বেতার ও টেলিভিশনে বিভিন্ন নাটকে অভিনয়সহ নাটক লেখা শুরু করেন। ষাটের দশকে টেলিভিশনে প্রথম ধারাবাহিক কৌতুক নাটক ‘হীরা-চুনি-পান্না’তে হীরার ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের মাঝে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিলেন। অসংখ্য চলচ্চিত্র তাঁর সুঅভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ৪ নভেম্বর মারা যান তিনি।
রবিউল
১৯৫৯ সালে ‘আকাশ আর মাটি’ ছবির মাধ্যমে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক প্রকৌশলী রবিউল আলমের। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করা এ অভিনেতার অন্যতম গুণ ছিল তিনি কুলার মতো কান দুটোকে তালে তালে নাচাতে পারতেন। উল্লেখযোগ্য ছবি ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), গুন্ডা (১৯৭৬), আলোর মিছিল (১৯৭৪), চৌধুরী বাড়ী (১৯৭২), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯), আকাশ আর মাটি (১৯৫৯) প্রভৃতি। ১৯৮৭ সালে মারা যান রবিউল।
আনিস
১৯৬০ সালে বিষকন্যা ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন আনিস। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় আনিস অভিনীত প্রথম ছবি জিল্লুর রহমান পরিচালিত ‘এই তো জীবন’। তারপর থেকে তিনি অভিনয় করেই গেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি অভিনয় করেছেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকে গোলাম হোসেন চরিত্রে অভিনয় করে তিনি মঞ্চে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আড়াই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি মারা যান।
টেলিসামাদ
টেলিসামাদ ১৯৬৬ সালে ‘কার বউ’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। চার দশকে প্রায় ৬০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। চারুকলা এবং সংগীতেও রয়েছে এ গুণী অভিনেতার পারদর্শিতা। দিলদার আলী ও মনা পাগলা ছবির প্রযোজনা, সংগীত পরিচালনা ও প্লেব্যাক করেছেন তিনি। এ দুই ছবিতে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক নজর কাড়েন এ অভিনেতা। ২০১৫ সালে তাঁর অভিনীত সর্বশেষ ছবি মুক্তি পায় ‘জিরো ডিগ্রি’। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল মারা যান এ জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা।
হাসমত
হাসমত ছিলেন একাধারে পরিচালক ও কৌতুক অভিনেতা। মঞ্চাভিনয় থেকে সত্তর দশকে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। হাবা হাসমত নামে একটি ছবি পরিচালনা ও এতে মর্মস্পর্শী অভিনয় করে এ নামেই খ্যাতি পান তিনি। নতুন বউ (১৯৮৩), আলোর মিছিল (১৯৭৪), রংবাজ (১৯৭৩), অবুঝ মন (১৯৭২), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯)-সহ শতাধিক ছবিতে অভিনয় এবং ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, এখানে আকাশ নীল, হাসি-কান্না, নকল মানুষ, মধুমিতা, হাবা হাসমত শিরোনামের ছবিগুলো নির্মাণ করেন তিনি। ২০১৪ সালে না ফেরার দেশে চলে যান এ অভিনেতা।
দিলদার
দিলদার বড় পর্দায় অভিনয়ে আসেন ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কেন এমন হয়’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তিনি ২০০৩ সালে সেরা কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ‘তুমি শুধু আমার’ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০০১ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
আরও যারা
চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে আরও যারা দর্শক মাতিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- ব্ল্যাক আনোয়ার, আফজাল শরীফ, লালু ও মন্টু, ফরিদ আলী, আবদুল আজিজ, শেখর আহমেদ, কাজল, জ্যাকি আলমগীর, রতন, সুরুজ বাঙালি, গিট্টু আজিজ, চিকন আলী, ববি, মতি, সোনা মিয়া প্রমুখ।