সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য পরিবার গঠনের উদ্দেশ্যে বিবাহবন্ধন হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রথা। বিবাহের মাধ্যমে যে পবিত্র বন্ধন তৈরি হয়, তা শুধু পরিবার গঠনে সহায়ক হয় না; বরং নৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা দেয়।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তোমার রব সর্বশক্তিমান।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৫৪)
ইমাম বুখারি (রহ.) বুখারি শরিফে এই আয়াতকে ‘কুফু’ অধ্যায়ের সূচনায় উল্লেখ করেছেন। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) তার কারণ উল্লেখ করে লিখেছেন, এই আয়াতকে এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা জানিয়ে দেওয়া যে বংশ ও শ্বশুর-জামাতার সম্পর্ক এমন জিনিস, যার সঙ্গে কুফুর ব্যাপারটি সম্পর্কিত। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে যাতে ভবিষ্যৎ বংশ রক্ষার ব্যবস্থা হয়, সেই দৃষ্টিতে কুফু রক্ষা করা একটা জরুরি বিষয়।
বিবাহবিচ্ছেদ ও দাম্পত্য কলহের যেসব কারণ গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে, এর সব কয়টি ইসলামের কুফু বিধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, বর ও কনের মধ্যে সমতা রক্ষা না করে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয় কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৫৩ বর্ষ, ১ম সংখ্যা)
ইমাম খাত্তাবি (রহ.) লিখেছেন, বহুসংখ্যক মনীষীর মতে, চারটি বিষয়ে কুফু বিচার্য—দ্বিনদারি, আজাদি, বংশ ও জীবিকা। তাঁদের অনেকে আবার দোষ-ত্রুটিমুক্ত ও আর্থিক সচ্ছলতার দিক দিয়েও কুফুর বিচার করেছেন। (পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃষ্ঠা-১০০)
ইমাম মালিক (রহ.) ধর্মকে কুফু নির্ধারণের জন্য গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ধন-সম্পত্তির দৃষ্টিতে কুফুর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।
হানাফি মাজহাবে কুফুর বিচারে বংশমর্যাদা ও আর্থিক অবস্থাও বিশেষভাবে গণ্য। এর কারণ এই যে বংশমর্যাদার দিক দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পার্থক্য হলে যদিও একজন অন্যকে ন্যায়সংগতভাবে ঘৃণা করতে পারে না, কিন্তু একজন অন্যজনকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে অসমর্থ হতে পারে, তা অস্বীকার করা যায় না। অনুরূপভাবে একজন যদি হয় ধনীর দুলাল আরেকজন গরিবের সন্তান, তাহলে যদিও সেখানে ঘৃণার কোনো কারণ থাকে না, কিন্তু একজন অন্যজনের কাছে যথেষ্ট আদরণীয় না-ও হতে পারে।
এসব বাস্তবতা সামনে রেখে দ্বিনদারি ও নৈতিক চরিত্রের পাশাপাশি বংশমর্যাদা, জীবিকার উপায় ও আর্থিক অবস্থার বিচার হওয়াও অন্যায় কিছু নয়।
বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে, মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে কুফু দেখার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পাত্রীর সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানের তুলনায় নিম্নমানের ছেলের কাছে বিবাহ দেওয়া উচিত নয়।
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বার্থে উত্তম নারী গ্রহণ করো এবং সমতা (কুফু) বিবেচনায় বিবাহ করো, আর বিবাহ দিতেও সমতার প্রতি লক্ষ রাখো।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৯৬৮)
বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি ঘটছে বলে জানা যায়। আর এই বিবাহবিচ্ছেদের কিছু কারণ হলো—
১. ইসলাম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব বিধান দিয়েছে, তা যথার্থভাবে পালন করা হচ্ছে না। বিধানগুলোর মধ্যে রয়েছে পাত্র-পাত্রী দেখা, পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, পাত্রীর সম্মতি, অভিভাবকের মতামতকে গুরুত্ব দান, কুফু রক্ষা করা, মোহরানা আদায় ইত্যাদি। এ ছাড়া পর্দার বিধান উপেক্ষা করে গায়ের মাহরাম পুরুষ-নারীর সঙ্গে মেলামেশা করা এবং বৈবাহিক জীবনে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য পালন না করা। (ড. মোহাম্মদ জাকির হুসাইন, আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদিসের অবদান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, গবেষণা বিভাগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগস্ট ২০০৪, পৃষ্ঠা-৫৪৬)
২. স্বামীর বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের অভাব, স্বামীর সীমিত আয়ে পারিবারিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক টানাপড়েন ও অপব্যয়, স্ত্রীর অধিক স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসবহুল জীবনযাপনের মোহ, স্বামীর স্ত্রীর পক্ষ থেকে অর্থলাভের মোহ এবং স্ত্রীর আয় ও অর্থ উপার্জনের ওপর স্বামীর কর্তৃত্ব খাটানোর প্রবণতা, স্ত্রীনির্ভরতা ইত্যাদি কারণেও অনেক বিবাহবন্ধন ছিন্ন হচ্ছে।
৩. বর-কনের মানসিক অপরিপক্বতা, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা ইত্যাদিকে বিবেচনায় না এনে ছেলে-মেয়েরা আবেগের বশবর্তী হয়ে বা মা-বাবা অর্থের মাপকাঠিতে পাত্র নির্বাচন করে বিবাহ দিলে তাতেও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সমঝোতার অভাব দেখা দেয়। এ ছাড়া ব্যক্তিত্বের বৈপরীত্য এবং কোনো না কোনো পক্ষের আনুগত্যের অভাব দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি করে। এই কলহ বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার দিকে নিয়ে যায়।
৪. দারিদ্র্য, অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং দ্রুত মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিকতার অবনতি ইত্যাদি।
৫. শারীরিক সমস্যা : শারীরিক কারণের অন্যতম হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যাপক তারতম্য।
কুফুর প্রধান দিকগুলো হলো—ক. গোত্রগত বা বংশগত দিক, খ. দ্বিনদারি ও আদর্শগত দিক, গ. পেশাগত দিক ও ঘ. অর্থনৈতিক দিক।
ক. গোত্রগত দিক : স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গোত্রীয় মর্যাদা নিয়ে পরস্পর গর্ব-অহংকার সৃষ্টি হয়। উচ্চ বংশমর্যাদাসম্পন্ন নারী নীচ বংশের পুরুষের অধীনে থাকতে ঘৃণা বোধ করে। তাই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে গোত্র ও বংশের সমতা রক্ষা করা অপরিহার্য। কিন্তু গোত্রীয় দিকটি সাধারণভাবে আরবের লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। (উবায়দুল্লাহ ইবন মাসউদ, শরহুল বেকায়া, কিতাবুন নিকাহ, বাব আল অলি ওয়াল কুফু)
অনারবদের ক্ষেত্রে ধর্মগত দিকটিই লক্ষণীয়। কারণ আরবরা তাদের গোত্রীয় ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ করে আসছে। আর অনারবদের বংশে অনেক মিশ্রণ ঘটেছে, যার ফলে তাদের বংশের মূল অস্তিত্ব আজ অক্ষত নেই।
আমাদের বাংলাদেশে বংশের দিকটির সমতা রক্ষা করা অপরিহার্য নয়। যদিও আজ অনারবদের মাঝে অনেক বংশের নাম শোনা যায়, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে বংশের নাম নয়; বরং একসময়কার উপাধি বা পেশা, যা বংশে
রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন—চৌধুরী, শেখ, কাজী, খন্দকার, তালুকদার, শিকদার, সৈয়দ ইত্যাদি পারিবারিক উপাধি দেখা যায়।
খ. দ্বিনদারি ও আদর্শগত দিক : বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে তাকওয়া ও ইসলামই কুফু হওয়ার মাপকাঠি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া অবলম্বনকারী।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
গ. অর্থনৈতিক দিক : অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি কেউ শুধু স্ত্রীর দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ দিতে সক্ষম হয়, সে ধনাঢ্য পরিবারের একজন মেয়ের জন্য কুফু হবে। (খন্দকার মুহাম্মদ ইউসুফ, ইসলাম জীবনের আলো, জামেয়া প্রকাশনী, ঢাকা, আগস্ট ১৯৯৩, পৃষ্ঠা-৭৬)
এ ক্ষেত্রে ধনের পরিমাণ কম-বেশি বিবেচ্য নয়। কারণ সম্পদ সব সময় এক হাতে থাকে না। এমন কত লোক আছে, যারা সকালে ছিল ধনী আর সন্ধ্যা হতে না হতে নির্ধন। আবার অনেক নির্ধনও আছে, যারা সকালে ছিল নির্ধন আর সন্ধ্যায় হয়ে গেল ধনী।
যে ব্যক্তি দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ দিতে সক্ষম নয়, সে একজন নির্ধন নারীর জন্য কুফু নয়। (শরহুল বেকায়া)
ঘ. পেশাগত দিক : পেশার দিক দিয়েও কুফু বা বর-কনের মধ্যে সমতা বিবেচনাযোগ্য। ঝাড়ুদার, জুতা সেলাইকারী, নাপিত, ধোপা, তাঁতি, কুমার, কামার, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী ইত্যাদি পেশার লোকের সঙ্গে আতর বিক্রেতা, কাপড় বিক্রেতা, মুদ্রা ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণির পেশাজীবীদের মেয়েদের কুফু হবে না। (শরহুল বেকায়া)
তবে এ দুই ধরনের পেশাধারীর মধ্যে নিজ নিজ শ্রেণির সঙ্গে কুফু হবে।
বিডি প্রতিদিন/মুসা