ফ্যাসিবাদী সরকারেরা যা করে থাকে আমাদের বিগত সরকারও তেমনটাই করেছে। কিছু মানুষকে টেনে নিয়েছে কাছে; লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়ে এবং প্রলোভন দেখিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর নীতি ছিল, অনুগতদের উদ্দেশে- দুহাতে টাকা কামাও। তিনিও সেটা করেছেন। তাঁর কাছের লোকেরা এবং ব্যবসায়ী ও আমলারাও ওই কাজ সমানতালে চালিয়ে গেছেন। তাঁদের ভয়ডর বলতে কিছু ছিল না। পুলিশের জন্য দেশটা ছিল উন্মুক্ত; রাজত্ব ছিল তাদেরই। তারা ঘুষ খেয়েছে, জবরদখল করেছে, বাণিজ্য করেছে গ্রেপ্তারের। পুলিশের বড় দায়িত্ব ছিল বিরোধীদের দমন করা। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে রাস্তায় পর্যন্ত দাঁড়াতে দেয়নি।
সে কাজ তারা কেমন দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, তার প্রমাণ রেখে গেছে অভ্যুত্থানের পূর্বমুহূর্তে। জনগণের টাকায় লালিতপালিত একটি বাহিনী নির্বিচারে এভাবে দেশের মানুষকে হত্যা করতে পারে, সেটা ছিল কল্পনাতীত। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারেরা গণহত্যা চালিয়েছে; তারা ছিল বিদেশি, পূর্ববঙ্গের মানুষকে তারা শত্রু ভাবতেই অভ্যস্ত ছিল। এবার বাংলাদেশি পুলিশ যা করল সেটাও গণহত্যাই। অবশ্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন তথ্যও ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এর পেছনে জাতিগত বিদ্বেষ ছিল না, ছিল কর্তৃপক্ষের হুকুম এবং বাহিনীটির স্বোপার্জিত নিপীড়নকারী চরিত্র।
ভানভনিতার আড়াল-আবডাল ভেদ করে বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার সত্যগুলো এখন বের হয়ে আসছে। সেগুলো পীড়িত মানুষের আর্তনাদের মতোই চাপা পড়ে থাকত যদি না দুর্দমনীয় প্রধানমন্ত্রী টের পেতেন যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পুলিশ বাহিনীর মতো নির্বিচারে অস্ত্র প্রয়োগে রাজি নয়।
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই দৃষ্টান্তও যে ক্ষমতায় টিকে থাকার এবং রাষ্ট্রকে নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী কতটা নির্মম হতে পারেন এবং তাঁর অনুসরণে দেশের সম্পদ কীভাবে লুণ্ঠিত ও বিদেশে পাচার হতে পারে। কেমন করে নিজের হাতে তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান দুমড়েমুচড়ে ভেঙেচুরে ফেলতে পারেন। এবং মাত্র কয়েক দিনে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে এবং হাজার পঁচিশেক মানুষকে আহত করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী তো কখনো কোনো উত্তেজনা প্রকাশ করেননি, ধীরস্থির ও ঠান্ডা মাথায় কাজ করেছেন। তবে ক্ষমতার লিপ্সা তাঁকে অমানবিক করে তুলেছিল। তিনি কি তাঁর পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছিলেন? কিন্তু কার ওপরে প্রতিশোধ? দেশের ওপর? দেশ তো ভূমি নয়, দেশ তো দেশের মানুষ। রক্ত ও অশ্রু তো মানুষেরই ঝরে, মাটির নয়। মাটি কেবল দেখে এবং সিক্ত হয়। একাত্তরে পাকিস্তানিরা বলত তারা মাটি চায়, মানুষ চায় না। কিন্তু এ দেশের প্রধানমন্ত্রী তো হানাদার ছিলেন না। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। ওই যুদ্ধের সন্তান বলেই দাবি করতেন। দাবিটা যে মিথ্যা ছিল তা-ও তো নয়। তাহলে? নাকি আমরা বলব ক্ষমতার লিপ্সা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতা একত্র মিশেছিল তাঁর মধ্যে? এবং তিনি মনে করেছিলেন তাঁর পতন কখনো ঘটবে না। কারণ তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী, আদালত, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী, দলীয় ক্যাডার এবং বিদেশি শক্তির সহায়তা দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন।
তো তিনি এবং তাঁর সঙ্গীদের অনেকেই চলে গেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের ভিতরে যে ফ্যাসিবাদী উপাদানগুলো রয়ে গেছে, তাদের কী তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন? না, সেটা তিনি করেননি। সেগুলোকে তিনি রেখে গেছেন আমাদের দুর্ভোগ বৃদ্ধির জন্য। তার প্রমাণ তো আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। পুঁজিবাদী উন্নয়নের সঙ্গে উপাদানগুলো জড়িত। ওই উন্নয়ন যত ঘটেছে তত বেড়েছে মানুষে মানুষে বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা; নিম্নগামী হয়েছে দেশপ্রেম। এবং এসব হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে অনিবার্যভাবে ঘটেছে এবং ঘটতে থাকবে ফ্যাসিবাদের পীড়ন। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সংকট বাড়বে। ফলে পীড়নও বাড়বে, এবং মানুষ বিদ্রোহ করতে চাইবে। বৃদ্ধি পাচ্ছে অরাজকতা ও প্রকৃতির বিরূপতা। সভ্যতা নয়, সংকটে পড়ছে মানুষের মনুষ্যত্বই। অস্তিত্বও।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আরও একটি সত্য সামনে নিয়ে এসেছে; সেটা তারুণ্যের শক্তি। এমনিতেই তারুণ্য যা করতে পারে বার্ধক্য তা করতে অপারগ। আর আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বয়স্করা যা দেবার ইতোমধ্যে দিয়ে ফেলেছেন, তরুণরাই যদি পারে তবে নতুন কিছু দেবে। কারণ তরুণদের আছে সাহস ও সংবেদনশীলতা; বয়স বাড়লে যা বাড়ে না, বরং উল্টো পথ ধরে। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রধান যে ধারা সেটা বুর্জোয়াদের। ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্ম নিয়ে কারবারি, উভয় ধারাই আসলে বুর্জোয়া ধারা। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর এখন সুখকর অবস্থা। রাষ্ট্রের সব শীর্ষ শিক্ষাঙ্গন, প্রশাসনে তারা সদলবলে ঢুকে পড়েছে। ধারণা করি সরকারের সঙ্গে তাদের রয়েছে গভীর সংশ্লিষ্টতা ও প্রভাব। তাদের লক্ষ্য সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাকে সুরক্ষা দেওয়া এবং নিজেদের সুবিধার জন্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। বুর্জোয়াদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তরুণরা সমাজে পরিবর্তন চায়, এবং তারা সাহস করে রুখে দাঁড়ায়। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল অনেকটা অভ্যুত্থানের মতোই। তার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শহীদ আবুল বরকত। ওই অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতাতেই উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ঘটে, যার প্রতীক ছিলেন শহীদ আসাদুজ্জামান, যিনি কর্মী ছিলেন কমিউনিস্ট ধারার। তাঁরা দুজনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাকিস্তানি শাসকরাও পুঁজিবাদী ঘরানারই ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের যে সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটল, সেটি পুঁজিবাদীই শুধু নয়, পরিণত হয়েছিল পুরোপুরি ফ্যাসিবাদে। আগের দুটি অভ্যুত্থানের সঙ্গে বর্তমান অভ্যুত্থানের চরিত্রেও একটা পার্থক্য রয়েছে। সেটা হলো এই যে এটিতে জনতার অংশগ্রহণ ছিল আগের তুলনায় অনেক বেশি। আন্দোলন শুরুতে ছিল সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য। তাতে সরকার পতনের তো নয়ই, এমনকি কোটাব্যবস্থার বাতিলের দাবিও ছিল না। সীমিত লক্ষ্যের সেই আন্দোলন যে এমন একটি অভ্যুত্থানে পরিণত হলো তার কারণ একাধিক। তবে প্রথম কারণ কিন্তু সরকারের নৃশংসতা। ফ্যাসিবাদী দুঃশাসকরা সীমা মানে না, কেবলই সীমানা ভাঙতে থাকে। আর ওই ভাঙার মধ্য দিয়েই তাদের পতন ঘটে। হিটলার আত্মহত্যা করেন। মুসোলিনি তাঁর দেশেরই বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারান। এবং আমাদের শেখ হাসিনা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান।
পতিত প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে অপমান করেছিলেন। তাতে তরুণরা ভীষণ অপমানিত বোধ করল, মধ্যরাতেই তারা বেরিয়ে এলো প্রতিবাদ জানাতে। এরপর এলো দ্বিতীয় আঘাত। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান মুখপাত্র বললেন, ওই নাতিপুতিদের মোকাবিলা করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ছাত্রলীগের সভাপতি মওকা খুঁজছিল; সে ঘোষণা করল, ‘আমরা প্রস্তুত’। তার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল আন্দোলনকারীদের ওপর। মেয়েরাও রেহাই পেল না। এরপর এলো পুলিশ; তারপর র্যাব ও বিজিবি; সর্বশেষ আর্মিকেও টহল দিতে দেখা গেল। ফল দাঁড়াল উল্টো। ছেলেমেয়েরা তো পিছু হটলোই না, সাধারণ মানুষও এলো এগিয়ে। তাদের ভিতর ক্ষোভ ছিল লাঞ্ছনা ও অপমানের। সেটা প্রকাশের নিয়মতান্ত্রিক পথ পাওয়া যেত নির্বাচন হলে। ওই পথ অবরুদ্ধ হাওয়াতে ক্ষোভটা প্রকাশ পেল এই অভ্যুত্থানে। মানুষের সহানুভূতি ছিল তরুণদের প্রতি, যেমনটা পিতা-মাতার থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের এগিয়ে যেতে দেখে অন্য তরুণরাও চলে এলো। তাদের বুকের ভিতর ঝড় উঠেছে, তারা বুক পেতে দিয়েছে। অনিবার্য হয়ে পড়ল অভ্যুত্থান।
প্রশ্ন থাকে রাজনীতিকরা যা করতে পারলেন না তরুণরা সেটা কেমন করে ঘটিয়ে ফেলল? জবাব হচ্ছে প্রথমত রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকলেও রাজনৈতিক দলের তরুণদের ছিল অদম্য সাহস। পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য যে তাঁর উপরওয়ালাকে বলেছেন, ‘গুলি করি, মরে একটা; বাকি ডি যায় না স্যার’, সেই অভিজ্ঞতাটা নিশ্চয়ই অন্য ছদ্মবেশী বন্দুকধারীদেরও।
তরুণদের নিজস্ব সাহসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি ও আস্থা। বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের মানুষ দেখেছে। তাদের ওপর আস্থা তো নয়ই, অনাস্থাই জমে উঠেছে ভিতরে ভিতরে। বিএনপির ডাকে যে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসত, তার কারণ ওই দলের প্রতি যতটা না সমর্থন, তার চেয়ে অধিক আওয়ামী লীগের শাসনে অসন্তোষ। বিএনপি নেতারা যখন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের আন্দোলন তখন স্তিমিত করা হয়েছে। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাও ছিল বৈকি। রাজনীতিকরা আগেও পারেননি, এবারও যে পারলেন না; এ থেকে তাদের অন্তত আত্মানুসন্ধানের সুযোগটা তো আছে।
তবে আমরা নিশ্চিত যে এ সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করবেন। রাষ্ট্র ও সামাজিক ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন তাঁরা ঘটতে দেবেন না। পরিবর্তন যাতে না ঘটে সেই লক্ষ্যেই কাজ করেছেন এবং করতে থাকবেন।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়