নাটকীয়তা আর রোমাঞ্চ ছড়ানো এক ম্যাচের ফুটবল উৎসব। চ্যালেঞ্জ কাপ ‘প্রিসিজন’ ফুটবলে ক্লাবের শক্তিমত্তা যাচাইয়ের চমৎকার সুযোগ। জড়তা কাটিয়ে একটি তাপ ছড়ানো ফুটবল ম্যাচ। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সম্ভাবনা আর অনিশ্চয়তা পাশাপাশি বিরাজমান।
দেশের ক্লাব ফুটবলে অভিজাত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বড় উপলক্ষ চ্যালেঞ্জ কাপ। আর তাই এই ম্যাচটির গুরুত্ব, মর্যাদা ও আকর্ষণ অন্য রকম। চ্যালেঞ্জ কাপের এটি দ্বিতীয় আসর। প্রথমবার ট্রফিটি ঘরে তুলেছে বসুন্ধরা কিংস মোহামেডানকে পরাজিত করে।
আবারও দেশের ফুটবলে ঐতিহ্যের ধারক মোহামেডান এবং দেশের ক্লাব ফুটবলে নতুন নজির সৃষ্টিকারী ও অন্যতম শক্তিধর হিসেবে ‘সার্টিফিকেট’ প্রাপ্ত বসুন্ধরা কিংস আগামীকাল শুক্রবার কুমিল্লা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে পরস্পর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জ কাপের ‘রেগুলেশন’ অনুযায়ী এই খেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গতবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ চ্যাম্পিয়ন (২০২৪-২৫) মোহামেডানের হোম ভেন্যু কুমিল্লায়। এটি পূর্ববর্তী লীগ শিরোপা বিজয়ী দলের প্রতি বাড়তি সম্মান প্রদর্শন বললে ভুল হবে না। ২৩ বছর অপেক্ষা করার পর গত মৌসুমে লীগ শিরোপা ঘরে তুলেছে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান।
অন্যদিকে পেশাদার লীগ খেলতে নেমে একনাগাড়ে পাঁচবার শিরোপা জয়ের পর গত মৌসুমে শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার পর ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বসুন্ধরা কিংস। রেগুলেশন অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ লীগের খেলা পূর্ববর্তী বছরের লীগ শিরোপা বিজয়ী এবং ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের মধ্যে হবে। দেশের বড় ফুটবল আসরে চ্যালেঞ্জ কাপ অনুপ্রেরণার বাতিঘর প্রতিটি ক্লাবের জন্য। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই বাফুফে এক দিনের এক ম্যাচের টুর্নামেন্ট শুরু করেছে। এ ধরনের এক ম্যাচের টুর্নামেন্ট দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশে অনুষ্ঠিত হয় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাম পথপ্রদর্শক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
প্রাণের স্পন্দনে জেগে উঠুক দেশের ফুটবলমাঠের ফুটবলের রহস্য তো আগাম বোঝার উপায় নেই। একটিমাত্র ম্যাচ। যতই বলি না কেন, উভয় দলই মাঠে মর্যাদার লড়াইয়ে লড়বে ফুরফুরে মেজাজে—সেটি কিন্তু হওয়ার নয়। আর এটি বাস্তবতা। যে দল স্নায়ু চাপ সামাল দিয়ে দলীয়ভাবে স্বাভাবিক ভালো খেলা খেলবে এবং পাশাপাশি ভাগ্যের সহায়তা পাবে—তারা শেষ হাসি হাসবে। লড়াই তো সেয়ানে সেয়ানে। কেউ তো কাউকে ছাড় দেবে না। চ্যালেঞ্জ কাপে জয়ী হওয়া মানেই আসন্ন ২০২৫-২৬ মৌসুমে বাকি আরো চারটি ট্রফি জয়ের বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়া! ফুটবল তো নিয়মের জালের মধ্যে বন্দি নয়। আর তাইতো দেখি ভালো এবং খারাপ রূপ। একদম কাছে এসেও তো তরি ডোবে। অকল্পনীয় ফলাফল দেখতে হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি, প্রথমবার কাপ জিতেছে বসুন্ধরা গ্রুপ পরিচালিত ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। আর রানার্স আপ মোহামেডান। যেহেতু গতবার লীগে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, আর তাই আগামীকালের চ্যালেঞ্জ কাপ তাদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জস্বরূপ। অন্যদিকে বসুন্ধরা কিংস সম্প্রতি এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগে সিরিয়ার শক্তিশালী ক্লাব দলকে পরাজিত করে দ্বিতীয় পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের ক্লাব হিসেবে বসুন্ধরা কিংসের এই সাফল্য দেশের সচেতন ফুটবল অনুরাগীদের আনন্দ দিয়েছে। এখন বসুন্ধরা কিংস এএফসি কাপে দ্বিতীয় পর্বে আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যে আবার তিনটি খেলায় অংশ নেবে। এ ক্ষেত্রে ভালো প্রস্তুতির জন্য খেলোয়াড়রা নতুন আর্জেন্টাইন কোচের অধীনে নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুশীলন করেছেন। এবারই প্রথম বসুন্ধরা কিংস লাতিন কোচকে নিয়োগ দিয়েছে। ভালো প্রস্তুতি সব সময় নির্ভার ফুটবল খেলতে সাহায্য করে। আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। চ্যালেঞ্জ কাপে নামার আগে বসুন্ধরা কিংস এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগে প্রাথমিক পর্বে কাতারের দোহায় ভালো খেলে জয়ী হয়েছে—এটি দলের খেলোয়াড়দের জন্য মানসিক বুস্টআপ। জয় সাহস এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
প্রশ্ন উঠেছে, কুমিল্লার মাঠে ফুটবল কতটুকু প্রাণবন্ত এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে পারে? ভালো ফুটবলের জন্য প্রয়োজন ভালো মাঠ। কুমিল্লার মাঠ এ ক্ষেত্রে কতটুকু যত্নসহকারে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে বলতে পারছি না। যেহেতু কুমিল্লা মোহামেডান ও আবাহনী এই দুই ক্লাবের হোম ভেন্যু, তাই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ২০২৫-২৬ রেগুলেশন অনুযায়ী (ধারা ৯) মাঠের পরিচর্যা এবং ভালো মাঠ প্রস্তুত করার সব দায়দায়িত্ব হোম টিমের। এ ছাড়া খেলা সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়াটাও হোম টিমের দায়িত্বে বর্তায়।
চ্যালেঞ্জ কাপের রেগুলেশন অনুযায়ী উভয় দল ১-৬-২০০৬ সালের পরে জন্মগ্রহণকারী একজন খেলোয়াড়কে একাদশে রাখবে। এটি তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য চমৎকার অভিজ্ঞতা এবং সুযোগ। প্রতিটি ক্লাবে পাঁচজন করে এ ধরনের খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক লীগে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে।
মোহামেডানের কোচ আলফাজ আহমদ। তিনি গত মৌসুমে লীগ শিরোপা অর্জন ছাড়াও চ্যালেঞ্জ কাপ ও ফেডারেশন কাপে রানার্স আপের সম্মান ক্লাব এবং অগণিত ভক্তকে উপহার দিয়েছেন। এবারের জন্য (২০২৫-২৬) আরো বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ক্লাবের ফুটবল ম্যানেজমেন্ট।
অন্যদিকে বসুন্ধরা কিংস অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত আর্জেন্টাইন কোচ মারিও গোমেজকে এক মৌসুমের চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছে। ক্লাবের লক্ষ্য হলো মৌসুমের পাঁচ শিরোপা ছাড়াও এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগের দ্বিতীয় পর্বে দাগ কাটা। এ ছাড়া তারা চাইছে ভারসাম্যপূর্ণ দল নিয়ে পাঁচটি মৌসুমে যখন তারা একনাগাড়ে শিরোপা জিতেছে, সেই খেলা আবার দর্শকদের উপহার দেওয়া। মাঠে তারা খেলোয়াড়দের মধ্যে চাইছে সেই আগের আত্মবিশ্বাস, সাহস ও জয়ের ক্ষুধা।
মোহামেডান ও বসুন্ধরা কিংস এই দুটি দল ভিন্নধর্মী ফুটবল খেলায় অভ্যস্ত। আমরা জানি, প্রতিটি ক্লাবেরই আছে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, লক্ষ্য ও কৌশল। একজন দেশি এবং একজন বিদেশি কোচের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়ে যাবে বিভিন্নভাবে। উভয় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে টেকনিক, ট্যাকটিকস এবং স্কিলের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। প্রিন্ট মিডিয়ায় তরুণ বন্ধুরা উভয় দলের সরলতা, দুর্বলতা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই পথে হাঁটতে চাচ্ছি না। এটি সত্যি বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবল কিন্তু নতুন এক ‘আয়নার’ মধ্যে। পেশাদার লীগে পাঁচটি দল আসন্ন মৌসুমে শিরোপার লড়াইয়ে থাকতে চাইবে—এটি কিন্তু অনেক বড় উত্তরণ দেশের ফুটবলে অনেক নেতিবাচক সমালোচনা সত্ত্বেও। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে একক নয়, দলগত পারফরম্যান্স এখন নজর কাড়ছে মাঠের লড়াইয়ে।
জয়ের আবির মেখে কুমিল্লা থেকে কোন দল ঢাকায় ফিরে আসবে—এটি দেখার জন্য আগামীকাল শেষ বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ফুটবলপ্রেমীরা চাইছে দূর থেকে একটি ভালো ফুটবল উপভোগ করতে। হার-জিত তো খেলার ধর্ম। ফুটবলের জয় হোক।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত