বিশ্বে নতুন গুঞ্জন, নানা প্রশ্ন। কাতারে ইসরায়েলের হামলায় মুহূর্তেই যেনো বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। এই ঘটনার পর সবচেয়ে বড় কাণ্ড ঘটিয়েছেন সৌদি যুবরাজ। কাতারে আরব ও মুসলিম নেতাদের সম্মেলন থেকে ফিরেই তিনি বিশ্ব দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়েছেন রিয়াদে। তার এক পদক্ষেপ ইসরায়েল থেকে শুরু করে ভারত, সবাইকে আতঙ্কে ফেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, সৌদি আরবকে কি আদৌ পাকিস্তান পারমাণবিক ছাতার তলে নেবে? মানে সংকটের সময়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে এই মারণাস্ত্র পাবে কি সৌদি?
পৃথিবীর বাঘাবাঘা বিশ্লেষকরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। তবে কারো হিসেবই ঠিকঠাক মিলছে না। পাকিস্তান ও সৌদির কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী, তৃতীয় কোনো দেশের আগ্রাসনের সময় উভয় দেশ এক সাথে রুখে দেবে। আর যে দেশই আক্রান্ত হোক না কেনো, তা বিবেচিত হবে দুই দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে। তাই ক্রান্তি কালে রিয়াদ ও ইসলামাবাদ লড়বে একসাথে।
সৌদি রাজধানী রিয়াদে আল ইয়ামামা প্রাসাদে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ চুক্তিতে সই করেন। দুই নেতা চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যায়িত করেন।
যৌথ ঘোষণাপত্রে বলা হয়, গত আট দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান কৌশলগত স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের ধারাবাহিকতায় এই নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হলো।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই চুক্তির উদ্দেশ্য হলো দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো এবং যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। কোনো এক দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসনকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে।
এতে বলা হয়েছে, এই চুক্তি শুধু দুই দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য নয় বরং পুরো অঞ্চলসহ বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান ও সৌদি আরবের যৌথ অঙ্গীকারের প্রতিফলন। চুক্তি সইয়ের পর সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বিন সালমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক বার্তায় লেখেন, সৌদি আরব ও পাকিস্তান... আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক সারিতে... চিরকাল এবং অনন্তকাল।
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সামরিক সহযোগিতার ইতিহাস কয়েক দশকের পুরনো। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বে যে সামরিক জোট গঠিত হয়, সেখানে পাকিস্তানের সহযোগিতায় বিশেষ বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। ওই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) রাহিল শরিফ।
তবে সদ্য স্বাক্ষরিত এই যৌথ কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি পাকিস্তান ও সৌদি আরব। এদিকে পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের পক্ষ থেকে এর প্রতিক্রিয়া এসেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির দিকে নজর রাখছি এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো খতিয়ে দেখছি। ভারত সরকার তার স্বার্থ রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শুধু সরকারই নয়, পাকিস্তান ও ভারতের সাংবাদিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরাও এই চুক্তি নিয়ে মতামত জানাচ্ছেন।
পাকিস্তানের সাংবাদিক তালাত হুসাইন প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের একটি ভিডিও শেয়ার করে লেখেন, এটি বিপুল সম্পদ এবং শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতার একীভূত হওয়ার মতো, এটি একটি গেম চেঞ্জার। এর চেয়ে সময়োপযোগী এবং কৌশলগত আর কিছু হতে পারত না।
দেশটির সাবেক মন্ত্রী মুহিদ হুসাইন সৈয়দ এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসেবে নীরবে পশ্চিমা বিশ্বকে প্রতিস্থাপন করেছে। এটি তিনটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কাতারের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও আমেরিকার বিশ্বাসঘাতকতার পর স্বাক্ষরিত; দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিন, কাতার, ইরান, লেবানন ও ইয়েমেনে হামলার সময়; তৃতীয়ত, ২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দক্ষতা প্রদর্শনের পর।
ভারতীয় সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার এক্সে লেখেন, কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা সংকটের মুখে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। কিন্তু ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুরের জন্য এর প্রভাব কী হবে?
ভারতীয় নাগরিক তেজস্বী প্রকাশ চুক্তি নিয়ে লেখেন, এক দেশের উপর হামলা অন্য দেশের উপর হামলা হিসেবে গণ্য হবে। এটি ইসলামাবাদের নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করবে। মোদি সরকার প্রোপাগান্ডা দিয়ে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে সরাচ্ছে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের প্রভাব কমছে।
পারমাণবিক অস্ত্র গবেষক রাবিয়া আখতার বলেন, দীর্ঘদিনের অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ককে এই চুক্তি আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে এটি আশ্বাস, তবে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়াদকে পারমাণবিক সুরক্ষা দেবে এমন সম্ভাবনা কম।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আফগানিস্তানের জন্য নিযুক্ত মার্কিন বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদ এই চুক্তিকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এটি কোনো আনুষ্ঠানিক ট্রিটি বা সন্ধি নয় এবং পাকিস্তান ও সৌদি আরব ‘ট্রিটি’ এবং ‘অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর মধ্যে পার্থক্য কীভাবে দেখছে তা স্পষ্ট নয়।
খলিলজাদ প্রশ্ন তুলেছেন, এক দেশের উপর হামলাকে অন্য দেশের ওপর হামলা হিসেবে গণ্য করা হবে; এটি কি কাতারে ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়া, নাকি পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত প্রচলিত গুঞ্জনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, যার পেছনে সৌদি অর্থায়ন রয়েছে?
তিনি আরও বলেন, চুক্তিতে কোনো গোপন শর্ত আছে কি? থাকলে সেগুলো কী? এটি কি সৌদি আরব বা অন্যান্য দেশের প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আস্থায় প্রভাব ফেলবে? পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র ও ডেলিভারি সিস্টেম রয়েছে, যা ইসরায়েলসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম। তারা এমন সিস্টেমও তৈরি করছে যা আমেরিকায় পৌঁছাতে পারে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল