রাখাইনে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির। সামরিক সক্ষমতা ধরে রাখা, অস্ত্র কেনা, যোদ্ধাদের রসদ জোগানো এবং সংগঠনের অন্যান্য খরচ নির্বাহে যে বিপুল অর্থ দরকার, তার উৎস হয়ে উঠেছে ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক কারবার। আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ কারবার চালাচ্ছে তারা। মাদক সাম্রাজ্যের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, যেখানে মাদক প্রবাহ দিনদিন বাড়ছেই। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত অঞ্চলের মাদক কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। অর্থনৈতিক কোনো বৈধ উৎস না থাকায় সংগঠনটি ইয়াবা পাচারকে আয়ের প্রধান পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এভাবেই তারা বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে।’ এ অভিযোগের সুর মেলান বিজিবি কক্সবাজার রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, সীমান্ত দিয়ে যে বিপুল পরিমাণ মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তার নেপথ্যে রয়েছে আরাকান আর্মি। তাদের সহযোগিতায় দেশমুখী ইয়াবার স্রোত এখন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকাজুড়ে আরাকান আর্মির প্রভাব বিস্তার ঘটেছে। এ অঞ্চলই কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’-এর অংশ, যা আন্তর্জাতিক মাদক উৎপাদন ও পাচারের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দুর্গম এই এলাকায় কোনো দেশেরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে ট্রান্সন্যাশনাল মাদক গ্রুপগুলোকে নিরাপদ রুট দিতে পারছে আরাকান আর্মি। তাদের মাদক ব্যবসার দুটি প্রধান ধারা রয়েছে। একদিকে আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলোকে রুট ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে কমিশন নেয় তারা, অন্যদিকে নিজেদের বাহিনী দিয়েই সরাসরি মাদক পাচার করে। তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার ইয়াবার চালানে কমিশন ধরা হয় প্রায় ৩ লাখ কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা)। কমিশনভিত্তিক পাচারের পাশাপাশি সমুদ্র ও স্থলপথে তারা সরাসরি চালান পাঠায় বাংলাদেশে। এ কাজের জন্য আরাকান আর্মির অন্তত ২০টি সক্রিয় সিন্ডিকেট রয়েছে।
প্রতিটি সিন্ডিকেটের রয়েছে আলাদা নেতৃত্ব ও দায়িত্ব বণ্টন। এর মধ্যে অন্যতম নেতা হোয়াই থিন, যিনি মূল সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন। আইন সাইন আরেক নামের এক নেতা তদারকি করেন স্থলপথের চালান, আর অং কিয়াং নিয়ন্ত্রণ করেন সমুদ্রপথ। এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ আয় করছে সংগঠনটি, যা সরাসরি তাদের সামরিক কার্যক্রমে ব্যবহার হচ্ছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীও তাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান চালিয়েছে। গত ২২ আগস্ট ইয়াঙ্গুন অঞ্চলের শ্বেপিথা ও হ্লেগু টাউনশিপে পরিচালিত অভিযানে ২৫৮ বিলিয়ন কিয়াত সমমূল্যের ইয়াবা জব্দ করে সেনারা। অভিযানে আরাকান আর্মির ১৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব অভিযানের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে এই সশস্ত্রগোষ্ঠী।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রায় ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটারের দুর্গম এলাকা ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’। ভারতের মিজোরাম, বাংলাদেশের বান্দরবান ও রাঙামাটি এবং মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য নিয়ে গঠিত এ অঞ্চল এতটাই দুর্গম যে, কোনো দেশের সেনাবাহিনী কার্যত সেখানে অভিযান চালাতে পারে না। এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে মাদক সিন্ডিকেটগুলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অঞ্চলের দুর্ভেদ্য ভূগোল এবং আইনের শাসনের দুর্বলতাকে পুঁজি করে আরাকান আর্মি মাদক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা। শুধু যুবসমাজ নয়, দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও এটি হয়ে উঠেছে এক মারাত্মক হুমকি।