‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’। প্রতিটি জীবন বাঁচতে চায়। বাঁচার জন্য আমাদের
কতনা আকুতি। তবু কিছু মানুষ বাঁচার আকাঙ্ক্ষাকে পায়ে দলে আত্মহত্যা করেন। নিজের জীবন নিজেই বিসর্জন দেন। করুণ পরিণতিতে নিজেকে সমর্পিত করেন। পরিবার-পরিজনসহ সবাইকে শোকে ভাসিয়ে দেন। জেনে আশ্চর্য হবেন পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন এবং বছরে প্রায় ৮-১০ লাখ মানুষ জীবন বিসর্জন দেন। সমগ্র পৃথিবীর আত্মহত্যাকারীর ২.৬% আমার বাংলাদেশের। বাংলাদেশের প্রতি বছর প্রায় পনেরো হাজার জন আত্মহত্যা করেন। ১৫-৩০ বছর বয়সের মানুষের মধ্যে এই হার বেশি। সম্প্রতি আত্মহত্যার এই হার বেড়েই চলেছে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। আর এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। এই সচেতনতা হতে হবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। আত্মহত্যার মূল কারণ মানসিক রোগ/মনোরোগ (৭০-৯০%)। এছাড়া বংশগতি (জেনেটিক), সামাজিক কারণ তো রয়েছেই। ইদানীং পারিবারিক ও সামাজিক কারণসমূহ উল্লেখ্য করার মতো। পারিবারিক কলহ, সামাজিক অস্থিরতা, সমাজিক সহিংসতা, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, সম্পর্ক/বিবাহ বিচ্ছেদ, সাইবার বুলিং সামাজিক কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম। মানসিক চাপ (স্ট্রেস) প্রতিরোধ/মোকাবিলা করার ব্যর্থতা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়, যা আমাদের তরুণ সমাজের আত্মহত্যার হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য আত্মহত্যা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা
(চেঞ্জিং দ্য ন্যারেটিভ অন সুইসাইড)
আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস
ক. আত্মহত্যার ঝুঁকিপ্রবণ নিকটজনকে চিহ্নিত করতে হবে (যেমন একাকী থাকা, ঘরকুনো, অসহায়ত্ব অনুভব করা ব্যক্তি,
আত্মহত্যার হুমকি দেওয়া, আত্মহত্যার নোট রাখা, আমার কেউ নাই/আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে এমন বক্তব্য দেওয়া,
মনোরোগে ভোগা ব্যক্তি, নিজের ক্ষতি করে এমন ব্যক্তি) এবং তাদের যত্ন নিতে হবে।
খ. যেহেতু আত্মহত্যার মূল কারণ মনোরোগ সুতরাং মনোরোগের অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে। (যেমন- ডিপ্রেশন,
সিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্ব সমস্যা ইত্যাদি)।
গ. মানসিক চাপ মোকাবেলা করার গুন অর্জন করতে হবে। সেজন্য শিশুকাল থেকেই সন্তানকে স্বাবলম্বী করতে হবে।
শৃঙ্খলা ও ভালোবাসা দিতে হবে।
ঘ. নিজের মনের যত্ন নিতে হবে এতে করে মানসিক চাপ মোকাবেলা করা যাবে। মনোরোগের হার কমানো যাবে।
ঙ. মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে মন মানুষের চালিকা শক্তি।
চ. সমাজকে সৃজনশীল, মননশীল কাজে অবদান রাখতে হবে। মাদকাসক্তি, সহিংসতা, কলহ, অস্থিরতা দূর করতে অবদান
রাখতে হবে।
ছ. রাষ্ট্রকে মানসিক স্বাস্থ্যের উৎকর্ষতা ও সমাজ সচেতনতার জন্য দ্বায়িত্ব নিতে হবে।
জ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে বুলিং এড়ানো, মাদকাসক্তি প্রতিরোধ, খেলাধুল ও সংস্কৃতি চর্চায় এগিয়ে আসতে
হবে।
ঝ. পাঠ্য কারিকুলামে বিভিন্ন পর্যায়ে মনোরোগের সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
আসুন সকলে মিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেষ্ট হই, নিজের/সন্তানের/পরিবারের/সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেই, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করি, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গড়ি।
অধ্যাপক ব্রিগে. জেনারেল মো. আজিজুল ইসলাম (অব.), এমবিবিএস, এফসিপিএস, এফআরসিপি (ইউকে), এফএসিপি (ইউএসএ), অধ্যক্ষ, ইউএস- বাংলা মেডিকেল কলেজ।