নোট অব ডিসেন্টসহ অনেকটা গোঁজামিল দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারে ঐকমত্য হলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এর বাস্তবায়ন নিয়ে। শেষ পর্যন্ত জুলাই জাতীয় সনদ ভেস্তে যেতে পারে এমন শঙ্কায় এর আইনি ভিত্তির ওপর জোর দিয়েছে প্রভাবশালী কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাদের যুক্তি দিনের পর দিন বৈঠকের পর তৈরি হওয়া ঐকমত্যের বিষয় যদি কোনো দল ক্ষমতায় এসে বাস্তবায়ন না করে তাহলে রাষ্ট্র সংস্কার হবে না। যেই লাউ সেই কদুই থেকে যাবে। তাই আইনি ভিত্তি ছাড়া এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অন্যদিকে কয়েকটি দল এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের যুক্তি, সব দল মিলে বৈঠকের পর বৈঠক করা হচ্ছে। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। মিডিয়াগুলো প্রতিদিন নিউজ প্রচার করছে। নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর দলগুলো তাদের ওপেন মতামত দিচ্ছে। এরপরে আইনি ভিত্তির যৌক্তিকতা কতটুকু। সবই তো হচ্ছে জনগণের সামনে। এটাই তো বড় ভিত্তি। নোট অব ডিসেন্টসহ ৮৪ বিষয়ে একমত হয় দলগুলো। তবে জটিলতা দেখা দেয় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর এই বিভেদ চ্যালেঞ্জে ফেলেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে। পথ খুঁজতে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি মতামত নিচ্ছে বিশেষজ্ঞ টিমের। কথা বলছে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইন বিশ্লেষকদের সঙ্গে। তৃতীয় দফায় বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করা হলেও দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করার ঘোষণা দিয়েছে কমিশন। এর মাঝে দলগুলোর সঙ্গে কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের কথা রয়েছে।
‘জুলাই সনদ’ আইনি দলিল হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এবং এর আইনি ভিত্তি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সেখানে বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থাপন হয়েছে। এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি, আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে কমিশন আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও আলোচনা করছে।
জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদকে একটি বাধ্যতামূলক আইনি দলিল হিসেবে উপস্থাপনের কথা বিবেচনা করছে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন। এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে একটি অধ্যাদেশ জারির জন্য সবগুলো রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি চাইছে কমিশন। অধ্যাদেশে থাকবে বিশেষ সাংবিধানিক অঙ্গীকার, যা অন্য সব আইন ও আদালতের রায়ের ঊর্ধ্বে জুলাই সনদের সর্বোচ্চ আইনগত প্রাধান্য নিশ্চিত করবে। সনদের সর্বশেষ খসড়া অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে বলা হবে যেন, জুলাই জাতীয় সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না। এটি বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে পুরোপুরি আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি বলছে, সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া যেতে পারে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি আইনি ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধান আদেশ বা গণপরিষদের পরামর্শ দিয়েছে। স্বৈরাচার যেন আবার ফিরে আসতে না পারে, এজন্য সব পক্ষকে ঐকমত্যে পৌঁছানোর তাগিদ দেন প্রধান উপদেষ্টা। বিএনপি বলছে, তারা সনদে সই করতে প্রস্তুত। তবে সাংবিধানিক বেশ কিছু বিষয় সংস্কারের ক্ষেত্রে পদ্ধতি কী হতে পারে, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে দলটি। দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিএনপি জুলাই সনদে স্বাক্ষরে প্রস্তুত। অঙ্গীকারনামা আছে একটি, সেটি নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। সনদ স্বাক্ষর হলে তার বাস্তবায়নে আমরা আশাবাদী। বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। তবে আমরা এমন কোনো পদ্ধতি চাই না, যার মাধ্যমে আইনের ক্ষমতার বাইরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা আমরা চাই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রশ্নাতীতভাবে যেন সনদ বাস্তবায়ন করা যায়, তাই সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।’ এদিকে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে অনড় অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী।
দলটি মনে করছে, সংবিধান আদেশ ২০২৫ জারি করলে ভবিষ্যতে এই সনদ আইনি চ্যালেঞ্জে পড়বে না। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘এমন একটা পদ্ধতিতে যেতে চাই, যাতে আগামীতে কেউ এই সনদকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। আর করলেও তা টিকবে না। তাই একে সংবিধান আদেশ ২০২৫ নামে অর্ডার জারি চায় জামায়াত। সেটা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।’ সংস্কারের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিষয়গুলোতে সমাধানে আসতে হবে জানিয়ে এনসিপি বলছে, গণপরিষদই হতে পারে সমাধান।
দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘শেষ প্রান্তে এসে আমরা আশা হারাতে চাই না। সংস্কারের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিষয়গুলোতে সমাধানে আসতে হবে। এত দিনের আলোচনায় জুলাই সনদ যেন আইনি ভিত্তি পায় সেটা আমরা চাই। ৮৪ পয়েন্টের মধ্যে ৪৩টি সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত, গণপরিষদের মাধ্যমে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’ গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও বিভাজনের দিকে উসকে দেওয়া হয়েছে। সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারও দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না। তিনি বলেন, গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যদি জনগণ এটি না মানে তাহলে কী হবে?
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে ‘সংবিধান আদেশ’ ও গণভোটের প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের প্রস্তাব আগামী ফেব্রুয়ারিতে যেদিন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, একই দিন গণভোটের মাধ্যমে সনদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে গণভোটের তারিখ (দিনক্ষণ) নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বলছে, জাতীয় নির্বাচনের পরে গণভোট। তবে সবাই একমত হলে নির্বাচনের দিন হতে পারে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে হবে আলোচনার টেবিলে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চায় জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করতে। আর সনদের ভিত্তিতেই হবে জাতীয় নির্বাচন। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে তারা রাজপথে আন্দোলনে নেমেছে। এনসিপি বলছে সংবিধান ইস্যুতে গণপরিষদ নির্বাচন জরুরি। এই গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান তৈরি করতে চায়। আর গণভোট নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবে।