একসময় ইউরোপের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে দেখা হতো ফ্রান্সকে। কিন্তু গত দুই বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন এবং এক মাসের মধ্যে দুজন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা দেশটিকে নতুন সংকটে ঠেলে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন ফ্রান্স হতে চলেছে ইউরোপের নতুন রুগ্ন মানুষ। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় এর অর্থনৈতিক অসুবিধা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতি মিলে তৈরি হওয়া নড়বড়ে অবস্থা বোঝাতে তুরস্ককে বলা হতো ইউরোপের রুগ্ন মানুষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, বহু সংকটে থাকা ফ্রান্সও হয়তো হাঁটছে সেই পথে।
সম্প্রতি ইতালির সংবাদমাধ্যমগুলো ফ্রান্সের এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছে। রোম ও তুরিনের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফরাসিদের বর্তমান পরিস্থিতিকে হিংসাত্মক আনন্দ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
ঋণের বোঝা ও অর্থনীতির সংকট
ফ্রান্সের প্রধান সমস্যা এখন বিপুল পরিমাণ জাতীয় ঋণ। দেশটিতে বর্তমানে জাতীয় ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ইউরো, যা জিডিপির ১১৪ শতাংশ। এই ঋণের সুদ পরিশোধেই সরকারের বার্ষিক খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৬৭ বিলিয়ন ইউরো। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই খরচ বেড়ে ১০০ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছাবে। যা শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা বাজেটকেও ছাড়িয়ে যাবে।
এই অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ফিচ ফ্রান্সের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে, সরকারের জন্য নতুন করে ঋণ নেওয়া আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। বিশ্লেষকদের মতে, অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বা ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ফিলিপ ডেজারটাইন এই পরিস্থিতিকে একটি ভঙ্গুর বাঁধের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, আমরা একটি বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, যা আপাতদৃষ্টিতে শক্ত মনে হলেও এর নিচে ক্ষয়ে যাচ্ছে। যেকোনো দিন সবকিছু হঠাৎ ভেঙে পড়তে পারে।
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অচলাবস্থা
প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এই সিদ্ধান্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। নতুন পার্লামেন্টে কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে বাজেট পাস করানো এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বায়রু বাজেট থেকে ৪৪ বিলিয়ন ইউরো কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু বাম ও অতি-ডানপন্থীদের বিরোধিতায় তিনি আস্থা ভোটে হেরে যান এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এই পরিস্থিতিতে ম্যাক্রোঁ তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সেবাস্টিয়ান লেকোর্নুকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। লেকোর্নুর প্রধান কাজ হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতা করে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে একটি বাজেট প্রস্তাব পেশ করা। সেই সাথে বছরের শেষে তা পাস করানো। কিন্তু এই কাজটি অত্যন্ত কঠিন। বামপন্থীরা ধনী ব্যবসায়ীদের ওপর কর আরোপ এবং পেনশন সংস্কার বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। ডানপন্থী রিপাবলিকান দল আবার এটা মানতে নারাজ। উভয় পক্ষের কেউই ছাড় দিতে রাজি নয়।
ম্যাক্রোঁর ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ
একসময় ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সের রাজনৈতিক বিভাজন দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন সেই ম্যাক্রোঁর নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে। সমালোচকরা বলছেন, ম্যাক্রোঁর ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই দেশটি এই সংকটে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিকোলাস বাভেরেজ এই পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খল, অক্ষম এবং ঋণের বোঝা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ম্যাক্রোঁ একজন গণতন্ত্রী হিসেবে আমাদের দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্সের এই সংকট মূলত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক। দীর্ঘদিনের জনতুষ্টিমূলক নীতি এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সুবিধাগুলো এখন দেশটির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ বুঝতে পারছে যে সংস্কার প্রয়োজন কিন্তু কেউই এর মূল্য দিতে রাজি নয়।
এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। হয় দেশের অন্তর্নিহিত শক্তি—অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠবে অথবা দেশটি বাম ও ডান উভয় প্রান্তের চরমপন্থীদের কবলে পড়ে স্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে যাবে।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল