ইসলামী আইন ও বিধি-বিধানের মূল লক্ষ্য মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করা। একেই এককথায় বলা হয় মাকাসিদে শরিয়াহ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনাকে (হে রাসুল) দ্বিনের সঠিক পথের (শরিয়তের) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি।’
(সুরা : জাসিয়া, আয়াতাংশ : ১৮)
আবারও বলা হয়েছে—‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বিন বিধিবদ্ধ (শরিয়াহ) করে দিয়েছেন,...তোমরা দ্বিন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ১৩)
পাপ-পঙ্কিলতাপূর্ণ পরিবেশ থেকে মুক্তির পথে নিয়ে আসাই শরিয়ার উদ্দেশ্য। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে—‘আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৩)
ইসলামের বিঘোষিত নীতি হলো, সহজ-সাবলীল জীবনবোধ। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘বান্দাদের ওপর আল্লাহর হক হচ্ছে, তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার করবে না।’ (মুসলিম)
তিনি (সা.) আরো বলেন, ‘দুনিয়া হলো নিন্দিত, দুনিয়ায় যা কিছু আছে সবই নিন্দিত। তবে ব্যতিক্রম হলো আল্লাহর জিকির ও এর মতো অন্যান্য বিষয় এবং আলিম ও জ্ঞান অন্বেষণকারী (তারা নিন্দিত নয়, বরং নন্দিত)।’ (তিরমিজি)
মানবজাতির কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহর যেসব উদ্দেশ্য ও হিকমত নিহিত রয়েছে তারই নাম মাকাসিদে শরিয়াহ। অর্থাৎ পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর ভাষ্যের মর্মার্থ, রহস্য ও হিকমত অনুসন্ধান এবং পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর তাৎপর্যের গভীরে প্রবেশ করা।
আমরা যখনই এসবের মর্মার্থের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হবো, তখন আমাদের জীবনের সঙ্গে শরিয়তের মেলবন্ধন ও কার্যকারিতা ঘটবে যথার্থরূপে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরিয়াহ ও সুস্পষ্ট পন্থা।’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৮)
আবারও সতর্ক করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি (হে রাসুল) আপনাকে দ্বিনের এক বিশেষ বিধানের (শরিয়তের) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং আপনি তার অনুসরণ করুন। আর যারা জানে না, তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করবেন না।’
(সুরা : জাসিয়া, আয়াত : ১৮)
বহুল প্রচলিত শব্দ মকসুদ (মাকসুদ)-এর বহুবচন মাকাসিদ আরবি শব্দ, যার অর্থ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। মাকাসিদে শরিয়াহ বলতে শরিয়তের অন্তর্নিহিত লক্ষ্যগুলো বোঝায়, যা মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন করে। মাকাসিদে শরিয়াহ মূল উপাদান হিসেবে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা পাঁচটি প্রধান উদ্দেশ্য চিহ্নিত করেছেন—
আদ দ্বিন (ধর্ম) : সব মানুষের ইসলাম ধর্ম পালনের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
আন-নফস (জীবন) : মানুষের জীবন রক্ষা করা এবং জীবনহানি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
আল আকল (বুদ্ধি) : মানুষের জ্ঞানার্জন ও বুদ্ধিভিত্তিক কাজ সম্পাদনের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
আন-নাসাব (বংশ) : মানুষের বংশের নিরাপত্তা ও বংশধারা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।
আল মাল (সম্পদ) : মানুষের সম্পদ রক্ষা করা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
মাকাসিদে শরিয়াহ তথা শরিয়তের অন্তর্নিহিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের প্রয়োজনীয়তার স্তরকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়—
১. আজ জরুরিয়াত (অত্যাবশ্যকীয়) : জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো। যেমন—ধর্ম, জীবন, বুদ্ধি, বংশ ও সম্পদ রক্ষা করা।
২. আল হাজিয়াত (প্রয়োজনীয়) : জীবনযাপনকে সহজ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো। যেমন—বিয়ে, ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি।
৩. আৎ তাহসিনিয়াত (সৌন্দর্য, বিলাসিতা) : জীবনকে সুন্দর ও পরিপাটি করার জন্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো। যেমন—খাবার ও পোশাকের উত্তম ব্যবস্থা করা।
এ উদ্দেশ্যগুলো বিশ্লেষণ করে শরিয়তের বিধানগুলো বোঝা এবং আধুনিক জীবনে শরিয়তের বিধানের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়।
বস্তুত মানব সৃষ্টির মূল লক্ষ্য, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে চেনা, তাঁর পরিচয় জানা এবং তাঁরই ইবাদত করা। শরিয়তের অন্তর্নিহিত লক্ষ্যও হলো মানুষের জীবনকে সুবিন্যস্ত করে মানুষের সুখ ও সৌভাগ্য নিশ্চিত করা। এতেই মানবসৃষ্টির সার্থকতা এবং কৃতজ্ঞ বান্দার যোগ্যতা প্রমাণিত হয়। ইসলাম শান্তির ধর্ম, বিশ্বধর্ম। সারা দুনিয়া মুসলমানের ইবাদতের গালিচাস্বরূপ। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘সহজ করো, কঠিন কোরো না; সুসংবাদ জানিয়ে আহবান করো, ভীতি প্রদর্শন করে তাড়িয়ে দিয়ো না।’ (বুখারি)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন