ইনসাফ ও ন্যায়বিচার এক মহৎ গুণ। ন্যায়বিচার ব্যক্তিকে সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয়পাত্র করে তোলে। শাসক বা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য ইনসাফ অপরিহার্য বিষয়। ইনসাফবিহীন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান সৎ ও প্রকৃত শাসক হতে পারে না।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ছিলেন ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের মূর্ত প্রতীক। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইনসাফের সুদীপ্ত আলো ছিল চিরভাস্বর, চির উজ্জ্বল ও চির বিরাজমান। তিনি নিজে ইনসাফ কায়েম করে গিয়েছেন এবং তাঁর অনুসারীদের ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদেশ করেছেন। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবী ও তাঁর উম্মতকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আদেশ করেছেন।
তিনি নবুয়তপ্রাপ্তির আগেও ইনসাফ কায়েম করেছেন। করেছেন পরেও। বন্ধু-শত্রু, দোস্ত-দুশমন ও মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনেও ইনসাফ কায়েম থেকে বিন্দু পরিমাণ পিছপা হননি।
প্রাক-নবুয়ত জীবনে ইনসাফ
রাসুলুল্লাহ (সা.) শৈশবে দুধমাতা হালিমা সাদিয়ার স্তন পান করেন। তিনি সব সময় তাঁর ডান স্তন থেকে দুধ পান করতেন। দুধভ্রাতা আবদুল্লাহ জন্য বাঁ দিকের স্তন রেখে দিতেন।
প্রাক-নবুয়ত যুগে সমাজে ইনসাফ কায়েমের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন হিলফুল ফুজুল নামে একটি যুব সংঘ। যার কর্মসূচি ছিল এতিম-অনাথ ও বিধবাদের সহায়তা করা এবং বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো।
নবীজির ইনসাফের প্রতি শতভাগ আস্থা ছিল কুরাইশদের। তাই কাবার দেয়ালে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে যখন মতবিরোধ হয়, তখন নবীজি (সা.)-কে তারা বিচারক হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা সবাই এক বাক্যে মেনে নেওয়ার কথা প্রকাশ করে। অবশেষে তাঁর ইনসাফপূর্ণ অপূর্ব ফয়সালা নির্দ্বিধায় মাথা পেতে মেনে নেয়।
পবিত্র কোরআনে ইনসাফ
পবিত্র কোরআনের ঘোষণা—‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদেশ করেন ইনসাফ, মঙ্গলসাধন ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার...।’
(সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(আপনি বলুন) এবং আমাকে আদেশ করা হয়েছে তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে...।’
(সুরা : শুরা, আয়াত : ১৫
আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে তোমরা আমানত তার পাওনাদারদের কাছে পৌঁছে দাও এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার করো তখন ইনসাফের সঙ্গে বিচার করো...।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
এ ছাড়া কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ইনসাফ কায়েমের হুকুম করা হয়েছে।
হাদিসের আলোকে ইনসাফ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইনসাফপূর্ণ ঘটনা হাদিস গ্রন্থগুলোতে অসংখ্য। তার মধ্যে কয়েকটি ঘটনা নিম্নে তুলে ধরা হলো—
জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন জিরানায় গনিমতের মাল বণ্টন করছিলেন, তখন জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বলল, ইনসাফ করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই আমি হতভাগা যদি আমি ইনসাফ না করি।’ (বুখারি, হাদিস : ৩১৩৮)
আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, হোনাইন বিজয়ের দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) গনিমতের মাল বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু লোককে প্রাধান্য দিলেন। অতএব, আকরা বিন হাবিসকে ১০০ উট দিলেন। উওয়ায়নাকেও দিলেন সমপরিমাণ। এবং আরবের কিছু সম্মানিত ব্যক্তিকে সেদিন গনিমতের মালে প্রাধান্য দিলেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহর শপথ! এই গনিমতের মাল বণ্টনে ইনসাফ করা হয়নি। এবং এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন উদ্দেশ্য করা হয়নি। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি নবীজির কাছে এ ব্যাপারে খবর দেব। অতঃপর আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলাম এবং বিষয়টি বর্ণনা করলাম। তখন তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যদি ইনসাফ না করেন তাহলে কে ইনসাফ করবে! আল্লাহ মুসার প্রতি রহম করুন। তাঁকে এর চেয়েও বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে। আর তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৩১৫০)
স্ত্রীদের সঙ্গে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের স্তম্ভ। ন্যায়বিচার ছিল তাঁর স্বভাবজাত বিষয়। উম্মাহাতুল মুমিনিনদের মধ্যে তাঁর ন্যায়বিচার উম্মতের নারীদের জন্য উত্তম আদর্শ। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) পালা বণ্টন করতেন ও ইনসাফ করতেন। এবং বলতেন, হে আল্লাহ! এটা আমার (পালা) বণ্টন, যার সামর্থ্য আমি রাখি। অতএব, আমাকে তিরস্কার করবেন না, যার সামর্থ্য আপনি রাখেন, আমি রাখি না। তিনি মনের (টান ও ভালোবাসা) উদ্দেশ্য নিতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১২৩৪; তিরমিজি, হাদিস : ১১৪০)
অমুসলিমদের সঙ্গে ইনসাফ
রাসুলুল্লাহ (সা.) কথাবার্তা, চাল-চলন ও অন্যান্য বিষয়ে মুসলিম-অমুসলিমদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। অর্থাৎ মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো ঘটনা ঘটলে তার সত্য ও ন্যায়ের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেন এবং নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতেন। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মুসলিমের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করে, তাহলে সে আল্লাহর সমীপে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন। আশআস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম। এটা আমার সম্পর্কেই ছিল। আমার ও এক ইহুদি ব্যক্তির মধ্যে যৌথ মালিকানায় এক খণ্ড জমি ছিল। সে আমার মালিকানার অংশ অস্বীকার করে বসল। আমি তাকে নবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, তোমার কোনো সাক্ষী আছে কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি ইহুদিকে বললেন, তুমি কসম করো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! সে তো কসম করবে এবং আমার সম্পত্তি নিয়ে নেবে। তখন আল্লাহ তাআলা (এ আয়াত) নাজিল করেন, ‘যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে...।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৭৭; বুখারি, হাদিস : ২২৫৬)
পরিশেষে বলা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমরণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিরোধানের আগে ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী একদল অনুসারী তৈরি করে গেছেন। যাঁরা মানবসভ্যতার ইতিহাসে ইনসাফ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। তাঁর ও তাঁদের প্রতি লাখো-কোটি দরুদ ও সালাম।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতুল আবরার দারুল উলূম আল-ইসলামিয়া উরশিউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন