গত শতকের আশির দশক। গ্রামের মাঝারিমানের গৃহস্থবাড়ি। প্রধান সড়ক থেকে কিছুটা সরু লম্বা মেঠোপথ বাড়ির দিকে যাচ্ছে। কিছু দূর গিয়ে ওই পথটি হারিয়ে গেছে খোলা মাঠের মতো চত্বরে। চত্বরের শেষ প্রান্তে চৌচালা টিনের ঘর। এটা ওই বাড়ির বৈঠকখানা বা কাচারিঘর। এই যে কাচারিঘর- এটাকে কেন্দ্র করে একটি পুকুর এবং একটি কাঁচা-পাকা যাই হোক, টয়লেটও অবশ্যই থাকবে। কোথাও কোথাও ধর্মবিশ্বাস অনুসারে উপাসনালয়ও থাকে। কাচারিঘরের পাশ ঘেঁষে মূল বাড়িতে প্রবেশের পথ। অনুমতি ছাড়া ওই পথে বাড়ির ভিতরে বহিরাগত বা সর্বসাধারণ সাধারণত যায় না এটাই গ্রামীণ ভদ্রতা।
বাড়ির সামনের এই কাচারিঘরের বহুবিধ ব্যবহার আশির দশকেও প্রচলিত ছিল। এটি ছিল গ্রামবাসীর মিলনকেন্দ্র। এখানে আদালতের মতো বিচার-সালিশও হতো। পুরুষ অতিথির জন্য রেস্টহাউস। এ ছাড়া সামাজিক উৎসব, আচার অনুষ্ঠান, বিয়েশাদিতে কাচারিঘরের গুরুত্ব অপরিসীম। এসবের বাইরে বাড়ির শিশু-কিশোরদের পড়ালেখার কাজে ব্যবহার হতো সবচেয়ে বেশি। গৃহশিক্ষকের বাসস্থান ছিল কাচারিঘর। কোনো কোনো বাড়িতে স্থায়ী কাজের লোক অথবা রাখালদের থাকার জায়গাও ছিল কাচারিঘর। চলতি শতকের নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না, সেই ‘কাচারিঘর’ ছিল মধ্যবিত্ত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের একটি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।
অন্যদিকে এই কাচারিঘর জমিদারদের ছিল খাজনা আদায় ও প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্র; এক কথায় অফিস। আর গৃহস্থ পরিবারের জন্য এটি গেস্টরুমের মতো বা বিশেষ বৈঠকের জায়গা, যেখানে পাড়াপ্রতিবেশী যথেচ্ছ আসতে পারত। কোনো বিরোধ ঘটলে বয়োজ্যেষ্ঠরা সেখানে বসতেন বিচার করতে। উৎসব হলে সংগীত-বাজনা, পিঠাপুলি, অতিথি আপ্যায়ন চলত। বস্তুত ঘরটি ছিল গ্রামের সামাজিক বন্ধনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
সময়ের পালাবদলে গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্মারক এই কাচারিঘর এখন প্রায় বিলুপ্ত। নতুন ঘর, আধুনিক সভাগৃহ, রাস্তার অভাব, নির্মাণে সর্বক্ষেত্রে খরচ এসব কারণে কাচারিঘরের গুরুত্ব কমে গেছে। অনেক বাড়িই ধীরে ধীরে সেটি বন্ধ করে দিয়েছে। শতবর্ষী সেই ঘরগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে ধসে পড়ছে।
দ্বীপজেলা ভোলায় ঐতিহ্যের স্মারক এই কাচারিঘর এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে বেশ কিছু বাড়ির সামনে দেখা যায়। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো অব্যবহৃত থাকে। কেবল স্মৃতির স্মারক হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে।
এই কাচারিঘরগুলো সংস্কারের মাধ্যমে কেবল পুরোনো দেয়াল-ছাদই রক্ষিত হবে না, নিকট অতীতের সামাজিক স্মৃতি, সেই সঙ্গে গ্রামীণ ঐতিহ্য বেঁচে থাকবে। যদি ফের মানুষের মিলনস্থল হয়ে ওঠে সেখানে বিচার-সালিশ, উৎসব, অতিথি আপ্যায়ন, গল্প-আড্ডা জমে ওঠে তাহলে এই কাচারিঘরই হয়ে উঠতে পারে সেকাল-একাল-আগামীকালের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধ।
স্থানীয় প্রশাসন এগুলোর কিছু রক্ষায় দায়িত্ব নিতে পারে। ঐতিহ্য কোনো বিলাসিতা নয়; এটি আমাদের গ্রামজীবন, পারিবারিক সখ্য ও সামাজিক সম্মানের মেরুদন্ড। তাই এই কাচারিঘরগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ ঐতিহ্য রক্ষারই প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা বলে বিবেচিত হবে।
♦ লেখক : গণমাধ্যমকর্মী