প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তাঁর সরকার এমন একটা নির্বাচন উপহার দেবে- যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অত ভালো নির্বাচন এ দেশের মানুষ আর কখনো দেখেনি। গত ছয়-সাত মাসে এই কথাটি তিনি কতবার বলেছেন, তার কোনো লেখাজোখা নেই। দেশবাসীর এক বিরাট অংশ অশেষ মুগ্ধতা সহযোগে এই সুবচন শ্রবণ করেছে, গলাধঃকরণ ও বিশ্বাস করেছে। তারা বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর! জনগণের এই অংশটিকে বলা যায়, আম আদমি। বাংলাদেশে আম আদমির কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এরা কোনো দলে গেলেও পাত্তা পায় না। আর যখন পাত্তা পায়, তখন সে হয়ে যায় বিশেষ। আরেক দল আছে যারা বিশ্বাস করার আগে অভিজ্ঞতার চশমা পরে যাচাই করে। তারা প্রশ্ন করে? তারা জানতে চাইবে, প্রশাসনকে যদি একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়, তাহলেও কি অতি ভালো নির্বাচন হবে? নির্বাচন মৌসুম আসার আগেই যদি ঝাঁটা মেরে কোনো প্রার্থীকে এলাকাছাড়া করা হয়, তাহলেও কি ইন্টেরিম খুব ভালো নির্বাচন করে দেখিয়ে দিতে পারবে? এরকম প্রশ্নে আপনি মেজাজ হারাতে পারেন? চোখ পাকাতে পারেন। ঠ্যাঁটা বলে গালি দিতে পারেন। কিন্তু সক্রেটিস বলেন ভিন্ন কথা। প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাই হচ্ছে জ্ঞানসূত্র। প্রশ্ন না করে সত্য জানা যায় না।
সত্যিকার অর্থে একটি ভালো, স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য যে উপাদানগুলো প্রয়োজন, সেগুলোর কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেসব গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের কত ভাগ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়েছে? অতীতের পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তাদের এবার নির্বাচনে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে না। এরকম খবর আমরা পত্রিকায় দেখেছি। খুবই ভালো খবর। কিন্তু নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট? অতীতের দলদাস অফিসারদের নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে দূরে রাখার মানে এই নয় যে নতুন করে এই জায়গাটায় অন্য কোনো দল প্রভাববলয় তৈরি করবে না। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলটি এই মর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের যে প্যানেল তৈরি হচ্ছে তাতে একটি বিশেষ দলের পুরোনো কর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। যাদের প্যানেলভুক্ত করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই নাকি অতীতে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিএনপি মনে করছে সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও কেউ কেউ পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন। সর্ববৃহৎ দলটি যখন এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ করে তখন বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিএনপির মতো দায়িত্বশীল একটি রাজনৈতিক দল হাওয়া থেকে পাওয়া খবরের সূত্র ধরে এরকম অভিযোগ তুলবে- এমনটি মনে করার সুযোগ নেই।
হতে পারে কাকতালীয়ভাবে এমনটি ঘটে গেছে। আবার খুব সচেতনভাবেই নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য অফিসার বাছাই করা হয়েছে একটি দলের পার্টিজানদের মধ্য থেকে। যদি এরূপ কাজ করার সুবিধা কোনো দল পেয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ডালমে কুচ কালা হ্যয়। নিয়ত খারাপ। ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়াত। নিয়ত খারাপ, তথাপি অতি ভালো নির্বাচনের এরেদাহ পূর্ণ হবে; তা-ও বিশ্বাস কি করা যায়? এ কথা বলছি না যে প্রধান উপদেষ্টার নিয়তে গড়বড় আছে! কিন্তু তাঁর ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে বা প্রশাসনের মধ্যে পক্ষপাতদুষ্ট ইলিমেন্ট থাকা বিচিত্র নয়। প্রশ্নটি এখনই আমলে নেওয়া না হলে পরে সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জিনিসটা রাজনীতির গভীরে শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। আমাদের রাজনীতিতে সবকিছু দখলে নেওয়ার মানসিকতা প্রবলভাবে বিদ্যমান। কেউ দখল করে আড়েঠাড়ে আর কেউ করে প্রকাশ্যে পেশিশক্তির বলে। অপ্রকাশ্যে যারা দখলে নেয়, তারা গভীর জলের মাছ। মেকিয়াভেলির দ্য প্রিন্সের মতো ধূর্ত। আর যারা পেশিশক্তির বলে একই কাজ করে তারা দখলও করে, বদনামও কামায়। তবে গণতন্ত্রের জন্য ধূর্ত কিংবা পেশিশক্তি কোনোটাই সুপাচ্য নয়। কিছু দিন আগে একটি দলের একজন বর্ষীয়ান নেতা সখেদে বলেছিলেন, আমরা দখল করি বালুমহাল, টেম্পোস্ট্যান্ড আর ওরা দখল করে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন ইত্যাদি। এর মানে হলো, আমাদের রাজনীতিতে দখলের কালচারটা বেশ ভালোভাবেই আছে। কাজেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুবিধার্থে ইলেকশনের সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়ে থাকতেই পারে। সেটা হয়ে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
কেন্দ্রের বাইরে নি-িদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও বুথের ভিতরে জালিয়াতিকাণ্ড ঘটতে পারে। কাজেই নির্বাচন পরিচালনার জন্য কর্মকর্তাদের যে প্যানেল তৈরি করা হয়েছে সেটা পুনরায় যাচাইবাছাই করতে হবে। এটা জরুরি। নির্বাচন ফ্রি-ফেয়ার করার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অত্যাবশ্যকীয়। সব দল ও মতের প্রার্থীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা অনুপেক্ষণীয় কর্তব্য। কাক্সিক্ষত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কনফার্ম করার প্রধান দায়িত্ব প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই জায়গায় কর্মকর্তারা পক্ষপাতদুষ্ট হলে সুযোগের সমতা সুরক্ষিত হবে না। সব প্রার্থীর মনমানসিকতা একরকম নয়। কেউ কেউ নির্বাচনে দাঁড়ান মারি অরি পারি যে প্রকারে। এই শ্রেণিটি নির্বাচনে জেতার জন্য যাচ্ছেতাই করতে পারে। ভোটার সাধারণের ম্যান্ডেটে এদের আস্থা নেই। আবার গণতন্ত্রমনা প্রার্থীরা জনগণের রায় মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। তারা জানেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয়- যে কোনোটাই ঘটতে পারে। তারা নির্বাচনের আগেই জনগণের মনে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পক্ষান্তরে যে প্রার্থী মনে করেন, তিনিই জিতবেন, যে করেই হোক জিততে তাকে হবেই- তারাই সমস্যা।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সেই সময়ের সরকারপ্রধানের আশ্বাসে বিশ্বাস করে বিএনপিসহ প্রায় সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ভোটের মাঠে নেমে অংশগ্রহণকারী দলগুলো দেখল যে তারা ভয়ংকর প্রতারণার শিকার হয়েছে। সেবার পরিকল্পিতভাবে আগের রাতে সিল মেরে বাক্স ভরার কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। কর্তব্যরত পুলিশ, আনসার, পোলিং অফিসার, ক্ষেত্র বিশেষে প্রিসাইডিং অফিসার নিজে এবং ক্ষমতাসীন দলের ষন্ডাবাহিনী মিলেমিশে মহাধুমধামের সঙ্গে রাতভর সিল মেরেছে এবং বাক্স ভরেছে। সেবার যদি এই সিলকাণ্ড না-ও ঘটত, তাহলেও সরকারি দলের প্রার্থীদের ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে জামানত রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ত, যদি সরকারি দল দয়া করে কিছু ভোট বিরোধীদের ভাগে ছুড়ে না দিত। কেননা সেবার স্ক্রুটিনি থেকে শুরু করে ভোট পর্যন্ত বিরোধী প্রার্থী, তাদের সমর্থক ও বিরোধী মনোভাবাপন্ন ভোটাররা ছিলেন অরক্ষিত ও অনিরাপদ। প্রার্থীদের অনেকে ছিলেন নিজ এলাকা থেকে ভদ্রভাবে নির্বাসিত। তাদের পোস্টার লাগাতে দেওয়া হয়নি, কথা বলতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচনে দাঁড়িয়েছ! এই বেশি। প্রচারের দরকার নাই। ভদ্রলোকের মতো বাড়ি চলে যাও। আর ভোটার; যারা ভাবছ বিরোধী মার্কায় সিল মারবা তারা বাড়িতে থাকো। কেন্দ্রে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। সেই অবস্থায় রাতে ভোট না হলেও কী ফল হতো তা সহজেই অনুমেয়।
এবারও ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, এমনটি বলার সুযোগ নেই। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বারবারই সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে শক্ত অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে। তবে সরকারের ভিতরে এবং প্রশাসনের মধ্যকার মহলবিশেষের ব্যাপারে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সংশয় রয়েছে বলেই প্রতীয়মাণ হয়। মাঠপর্যায়ের প্রশাসন বিশেষ করে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা তো এখনই প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে। তদুপরি একশ্রেণির লোকের অগণতান্ত্রিক মানসিকতার প্রাবল্যদৃষ্টে উদ্বিগ্নবোধ হয়। কদিন আগে দেখলাম একটি নির্বাচনি এলাকায় সচেতন নারীসমাজের ব্যানারে একদল মহিলা ঝাড়ুমিছিল করছেন। তারা ওই এলাকায় একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। তারপরও যদি এলাকায় প্রার্থী যান তাহলে ঝাড়ুপেটা করবেন। যে এলাকার মা-বোনেরা ঝাড়ুপেটা করার ভয় দেখাতে পারেন, সেই এলাকার রাজনীতির বীরপুরুষদের পক্ষে একই কাজে জুতো, বন্দুক, চাপাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে কতক্ষণ! মবোক্রেসির যে স্টাইলটা আমরা চালু করে দিয়েছি সেটা ভোট অবধি যদি জারি থাকে তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কেমনে হবে?
এবার নাকি পোস্টার হবে না। আগের মতো ক্যাম্পেইন হবে না। সব প্রার্থীকে একমঞ্চে এনে পরিচিতি সভা করা হবে। খুব ভালো। কিন্তু যে প্রার্থীকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে, যাকে ঝাড়ু দেখানো হয়েছে এবং এই ধারাটি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ওই প্রার্থী কী করে পরিচিতি সভায় যাবেন! কী করে তিনি ক্যাম্পেইন করবেন? এসব অগণতান্ত্রিক রীতিনীতি বদলাতে হবে।
তা না হলে প্রত্যাশিত ভালো নির্বাচন করা কঠিন হতে পারে। যে কোনো মূল্যে ঘোষিত টাইমফ্রেমের মধ্যে ফ্রি ও ফেয়ার নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক