উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার সুরের আবির শ্রোতার মনে বইয়ে দেয় প্রশান্তির হাওয়া। বৈচিত্র্যময় আর মনমাতানো গানে গানে কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ কণ্ঠশিল্পী বিলিয়ে এসেছেন নানা রঙের অনুভূতি। তাঁর সুরসমুদ্রে ভেসে যেতে ইচ্ছা করে সব বয়সি শ্রোতারই। লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক- সব ধাঁচের গানই গেয়েছেন তিনি। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজিসহ ১৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। ১৯৬৪ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ভাষার ‘জুগনু’ চলচ্চিত্রে ‘গুডিয়াসি মুন্নি মেরি’ গান দিয়ে সংগীতাঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকার সুরকার সুবল দাস রুনা লায়লাকে দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের ‘স্বরলিপি’ ছবিতে গান করালেন। গানটি ছিল ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বলো কী হবে।’ গানটি সুপারহিট হয়। এ গানই রুনা লায়লার সংগীত জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। স্বাধীনতার পর নিজ সিদ্ধান্তে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন রুনা লায়লা। কিন্তু ১৯৭৪-৭৫ সালে যখন রুনা লায়লা বাংলাদেশে এলেন তখন তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো যে তিনি বাংলাদেশে গান গাইতে পারবেন না। না রেডিও, না টেলিভিশন, না চলচ্চিত্রে। এর মাঝেই রুনা লায়লা টেলিভিশনে একটি আবেদন করেছিলেন। তখন টেলিভিশন থেকে বলা হয়েছিল, গান গাইতে চাইলেই তো আর গান গাওয়া যায় না, অডিশনের মাধ্যমে লিস্টেট হতে হবে, তারপর দেখব সুযোগ দেওয়া যায় কি না। এটা যে কত বড় অপমানের যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়, কারণ পুরো এশিয়া মহাদেশে রুনা লায়লা হার্টথ্রব একজন কণ্ঠশিল্পী। দর্শকরা তাঁর গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে। যখন রুনা লায়লা কোথাও গান গাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন না, তখন ওই সময় মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা একটি ছবি প্রযোজনা ও পরিচালনা করবেন, ছবিটির নাম ‘এপার ওপার’, ছবির গান রেকর্ডিং করবেন। সবকিছু রেডি, ডুয়েট গান, স্টুডিওতে ছেলে কণ্ঠশিল্পী এসেছেন। এরপর রুনা লায়লা এসেছেন, মিউজিক ডিরেক্টর আজাদ রহমান, তখন রুনা লায়লাকে দেখে ছেলে কণ্ঠশিল্পী আর গাইবেন না, ওনি মিউজিক ডিরেক্টরকে বললেন তিনি রুনা লায়লার সঙ্গে গান গাইবেন না, কারণ রুনা লায়লাকে ব্যান করা হয়েছে, সেই শিল্পীর কথায়- আমি যদি তাঁর সঙ্গে গান করি তাহলে আমাকেও ব্যান করবে, এই বলে তিনি চলে যান। এ অবস্থা দেখে সোহেল রানাকে রুনা লায়লা বললেন, আমি কি চলে যাব, তখন সোহেল রানা বললেন, না আপনি যাবেন না, আপনিই আমার ছবির গান গাইবেন, তখন রুনা লায়লা সোহেল রানাকে বলেন, ছবিটি নিয়ে সেন্সরে ঝামেলা করবে, উত্তরে সোহেল রানা বলেন, সেটা আমি দেখব, আপনি গাইবেন, আমি অন্য ছেলে শিল্পী আনার ব্যবস্থা করছি। তারপর অন্য শিল্পী এনে রিহার্সেল করে গান রেকর্ড করেন। এ কথা চলচ্চিত্র দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। তারপর একে একে সবাই রুনা লায়লাকে নিয়ে গান করা শুরু করলেন। সেদিন যদি এ উদ্যোগটি সোহেল রানা না নিতেন হয়তোবা বাংলাদেশে কোনো দিনই রুনা লায়লা গান গাইতে পারতেন না। তাই এক অনুষ্ঠানে রুনা লায়লা সোহেল রানাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- ‘আসলেই আপনি একজন রিয়েল হিরো’। এ প্রসঙ্গে রুনা লায়লা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমি গান গাইছিলাম। ভালো চলছিল। সত্তর দশকের মাঝামাঝি তখনকার সব শিল্পী আমাকে বয়কট করল। হঠাৎ করে তারা বলল, আমার সঙ্গে কেউ গাইবে না। একই স্টেজে দাঁড়াবে না। কোনো মিউজিশিয়ান আমার সঙ্গে বাজাতে পারবে না। কোনো স্টুডিও রেকর্ডিং করতে পারবে না। সত্যি বলতে আজ পর্যন্ত এর কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। হয়তোবা কারও আমার প্রতি রাগ ছিল। তবে একটা বিষয় আমাকে তখন খুব কষ্ট দিচ্ছিল; কারণ যে সময়টায় আমাকে বয়কট করা হয়েছিল, ওই সময়টায় আমার বড় বোনের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তার ক্যানসার ধরা পড়ে। সে তখন খুবই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় ছিল। আমি ওটা নিয়ে এত চিন্তিত ছিলাম, তারপরও ওদের সংস্থার অনুষ্ঠানে যাই, সবই করি।
কিন্তু তারপরও কেন আমার সঙ্গে এমন হয়েছিল তা আজও জানি না। পারভেজ (মাসুদ পারভেজ) সাহেব উদ্যোগ নিয়েছিলেন; তিনি বলেছিলেন, ‘কীসের কী বয়কট। আমি এসব মানি না। আমি প্রযোজক, যাকে খুশি তাকে দিয়ে গাওয়াব। এখানে কেউ আমাকে বলার কিছু নেই।’ আমার এক সহশিল্পী ছিলেন, তিনি স্টুডিওতে আমাকে দেখে বইটই ছুড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘রুনা লায়লার সঙ্গে গান গাইব শুনলে আমি তো আসতামই না।’ যাক, শেষ পর্যন্ত দ্বৈত গান আমি একাই গেয়েছি। ঘটনাটা ইপসা স্টুডিওতে ঘটেছিল। তবে এ বয়কট খুব বেশি দিন ছিল না। সবাই দেখল, আমি ছবিতে গান করছি, কেউ মানছে না। মিউজিশিয়ানরাও বাজাচ্ছে। মিউজিক ডিরেক্টররাও কাজ করছে। এসব বয়কট করে তো লাভ হচ্ছে না। তখন একটা সময়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়।