ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম হজ। আরবি ‘হাজ্জুন’ শব্দ থেকে হজ শব্দের উৎপত্তি। এর আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের নির্ধারিত দিনগুলোতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) ও সংশ্লিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত করাকে হজ বলে। এ প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষে বলা হয়েছে ‘শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে গমনাগমন, মিনায় অবস্থান প্রভৃতি কার্য হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেভাবে সম্পাদন করার নাম হজ। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম (ই.ফা.বা. কর্তৃক প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২৩)।’
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের মধ্যে তার ওপর আল্লাহর জন্য এ ঘরে হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে (সুরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৯৭)।’ মূলত মক্কা মুয়াজ্জামায় গিয়ে হজ পালন করার মতো শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সামর্থ্য যার রয়েছে, তার জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ করা ফরজ। হজ নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট আমলের মাধ্যমে আদায় করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের আগে ও পরে কাবাঘর তাওয়াফ ও জিয়ারত করলে সেটি হজ হবে না, বরং ওমরাহ আদায় হবে। জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পাঁচ দিন হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান হলো পবিত্র কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাহ ও মুজদালিফা। দূরবর্তী হাজিদের জন্য মদিনা শরিফে হজরত রসুল (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করা। হজের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে- ইহরাম, তালবিয়া, তাওয়াফ ও সাঈ, ওয়াকুফে মুজদালিফা, ওয়াকুফে মিনা, কঙ্কর নিক্ষেপ, দম ও কোরবানি, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা এবং জিয়ারতে মদিনা রওজাতুর রসুল ইত্যাদি। হজ ফরজ হওয়ার শর্তগুলো হলো- ১. মুসলমান হওয়া, ২. সুস্থ ও বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া (অসুস্থ ও পাগলের জন্য হজ ফরজ নয়), ৩. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, ৪. আজাদ তথা স্বাধীন হওয়া, ৫. শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া, ৬. হজের নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হওয়া। হজের ফরজগুলো হলো- ১. ইহরাম বাঁধা (আনুষ্ঠানিকভাবে হজের নিয়ত করা), ২. ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা, ৩. কাবা শরিফ জিয়ারত করা (১০ জিলহজ ভোর থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত যে কোনো দিন কাবা শরিফ তাওয়াফ করা)। হজের ওয়াজিবগুলো হলো- ১. ৯ জিলহজ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা, ২. সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাঈ করা, ৩. ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ পর্যায়ক্রমে মিনায় তিনটি নির্ধারিত স্থানে ৭টি করে শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা, ৪. কোরবানি করা, ৫. ইহরাম খোলার জন্য মাথার চুল মুণ্ডন বা চুল কেটে ছোট করা, ৬. বিদায়ি তাওয়াফ করা। অর্থাৎ বহিরাগত হাজিগণ দেশে ফেরার আগে বাইতুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, ৭. দম দেওয়া (ভুলে বা স্বেচ্ছায় হজের কোনো ওয়াজিব বাদ পড়লে তার কাফফারা হিসেবে একটি অতিরিক্ত কোরবানি দেওয়া)।
হজের সুন্নতগুলো হলো- ১. কাবা শরিফ পৌঁছেই প্রথমে তাওয়াফ করা, ২. সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ করার সময় দ্রুতগতিতে চলা, ৩. কোরবানির দিনগুলোয় রাতে মিনায় অবস্থান করা, ৪. ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের আগে মুজদালিফা থেকে মিনার উদ্দেশে রওনা করা, ৫. তিন জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপের সময় ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
হজ তিন প্রকার, যথা- ১. হজে ইফরাদ, ২. হজে তামাত্তু, ৩. হজে কিরান। হজে ইফরাদ : শুধু হজ পালনের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পাঠ করাকে ‘হজে ইফরাদ’ বলে।
হজে তামাত্তু : হজের মাসগুলোতে প্রথমে ওমরাহ আদায় করে হালাল হয়ে বাড়ি প্রত্যাবর্তন না করে এ বছরই হজের ইহরাম বেঁধে হজ পালন করাকে হজে তামাত্তু বলে।
হজে কিরান : একই সময়ে হজ ও ওমরাহ পালনের নিয়ত করে ইহরাম বাঁধাকে হজে কিরান বলে।
হজরত মা হাজেরা (আ.) স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর জন্য পানি সংগ্রহের জন্য সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়েছিলেন। হাজিরা তাঁকে অনুসরণ করে সাফা-মারওয়া দৌড়ে থাকেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করে নিজে সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রকাশ করে হাজিরা আজও কাবাঘর থেকে সাতবার তাওয়াফ করে থাকেন। রসুল (সা.) জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশে বিদায় হজের খুতবা প্রদান করেছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করে হাজিরা আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হন।
লেখক : সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, পিইউবি