দেশের সবখানে এখন কেবলই মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির কথা। বেদনা-বিক্ষোভে বাতাস ভারী ও তপ্ত হয়ে উঠেছে। শিশু- সন্তানহারা পিতা-মাতা এখনো স্তব্ধ-বিমূঢ়। স্বজন-পরিজনের মুখে সান্ত্বনার কোনো ভাষা নেই। আছে শুধু চোখের পানি। হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতর দগ্ধ ফুলের শিশু। যে শিশুর মুখে এখনো লেগে রয়েছে মায়ের দুধের ঘ্রাণ, সেই শিশু; সেসব শিশু জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে লড়াই করে চলেছে। ভাবতে গেলে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে দলা পাকানো কষ্ট। প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। এ প্রশ্নের উত্তর খ্ুঁজতে মানুষ ঘুরপাক খাচ্ছে সত্য মিথ্যা ও গুজব-গুঞ্জনের ঘূর্ণিপাকে। কেউ কেউ সামনে নিয়ে আসছেন ষড়যন্ত্রতত্ত্ব।
পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিও থেমে নেই। গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি তো থাকতেই হবে। তবে আমাদের রাজনীতি সঠিক পথে চলছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্নও আছে। রাজনীতিতে কৌশল জিনিসটি খুব দরকারি। দলগুলোকে কৌশল করেই পথ হাঁটতে হয়। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু কৌশল আর চক্রান্ত যে এক নয় তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বোঝেন। পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সহজ গণতন্ত্রের পথটাকে কঠিন করে দিতে মহলবিশেষ বেশ তৎপর। বিএনপির আশঙ্কা প্রতিশ্রুত সময়ে যাতে সাধারণ নির্বাচন না হতে পারে তার জন্য ফন্দিফিকির চলছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঐক্যের পথে বেশি দূর অগ্রসর হতে না পারলেও গত মঙ্গলবার একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তটি হলো কোনো দলীয় প্রধান দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এ সিদ্ধান্তে বিএনপির সায় নেই। ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য, দুয়েকটি দল এর বিরোধিতা করলেও বেশির ভাগ দল এ সিদ্ধান্তের পক্ষে। মেজরিটি মাস্ট বি গ্র্যান্টেড। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে বেশির ভাগ দলের কথা বলা হচ্ছে, তারা নাগরিকদের কত শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে? ভোটের আগে এ হিসাব বের করা কঠিন। এ সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নেওয়া দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সর্ববৃহৎ। অতীতে যে নির্বাচনগুলোতে জামায়াত পার্টিসিপেট করেছে সেসবের ফলাফলের ভিত্তিতে এ দলের জনসমর্থনের একটা ধারণা পাওয়া যায়। সেই হিসাব মাথায় রেখে বলা যায়, জামায়াতে ইসলামী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। অন্যান্য দলের মধ্যে এমন অনেক পার্টি রয়েছে, যারা এর আগে কোনো ভোটে অংশ নেয়নি। এনসিপি এখন পর্যন্ত অনিবন্ধিত। সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের দাবি করতে পারে কেবল বিএনপি। কাজেই বিএনপির অভিমত উপেক্ষিত হওয়ার অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মত উপেক্ষা করা। এটিই নিরেট বাস্তবতা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগে বলা হয়েছিল যে কয়টি বিষয়ে সব দল একমত হবে সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেই অবস্থানে নেই। একমত না হলেও কমিশন সনদের ভিন্নমত পোষণকারী দল বা দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টসহ প্রস্তাবিত সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এতে কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। উল্লেখ্য প্রধান উপদেষ্টা নিজে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি। কাজেই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে প্রধান উপদেষ্টাও নিরপেক্ষ থাকেন না। এটাই সরল উপসংহার।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভিতরে নাকি আরেকটি সরকার রয়েছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় এ কথা বলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠদের অন্যতম। তিনি শেখ হাসিনা আমলের অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উপরন্তু তিনি একজন তথ্যাভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী সুশীল। সুতরাং তার বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে বলছেন, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে কোণঠাসা করে দেওয়ার গভীর একটা ষড়যন্ত্র চলছে। যারা এটা করছেন তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিষ্ক্রিয় বা অকার্যকর করে দেওয়ার কৌশল বাস্তবায়ন করতে নানা রকম ফিকির করে চলেছেন। এ ক্ষেত্রে এমনসব দাবি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে, যেগুলো মেনে নেওয়া হলে শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। তারেক রহমান ও বিএনপিকে দুর্বল করে দিয়ে একটি বিলম্বিত ও একতরফা ইলেকশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়াই হয়তো মহলবিশেষের অভিলক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তারা সামাজিক মাধ্যমকেও ব্যবহার করছে। বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ বিবর্জিত একশ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল ও অপরিণামদর্শী নেতা-কর্মীকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দল ওই সব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও পুলিশ প্রশাসন ওদের গ্রেপ্তার করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারেক রহমান নিজেও এ ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তাহলে কি প্রশাসন বিএনপির লেবেলধারী গুন্ডা, চাঁদাবাজ ও মবোক্র্যাটদের প্রশ্রয় দিয়ে দলটিকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কৌশল করে চলেছে?
প্রশ্ন হলো, বিএনপিকে কেন কোণঠাসা করতে চাওয়া হচ্ছে? কারাইবা করছে এ চক্রান্ত? প্রথমোক্ত প্রশ্নের অতি সরলীকৃত জবাব হচ্ছে বিএনপির জনপ্রিয়তাই এর কারণ। ফ্রি-ফেয়ার ও প্রচলিত আসনভিত্তিক নির্বাচন হলে বিএনপিকে পেছনে ফেলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। কাজেই ‘মারি অরি পারি যে প্রকারে।’ অর্থাৎ যেভাবেই হোক, ষড়যন্ত্র বা চালাকি করেই হোক অরি (শত্রু) নিধন করতে হবে। চাণক্যের এ নীতিকেই হয়তো শিরোধার্য করে নিয়েছেন তারা।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গভীর-সন্ধানী পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, বিএনপিকে কোণঠাসা করে পেছনে ঠেলে দিতে চাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আরও ডিপরুটেড কোনো কারণ। ইতিহাসের রিসেট বাটন টিপে দেওয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে যারা বাংলাদেশের ইতিহাসে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে চান, তারা বিএনপিকে টার্গেট করবেন-এটাই স্বাভাবিক। বিএনপির জন্ম মুক্তিযুদ্ধের ছয়-সাত বছর পরে। কিন্তু এ দলের মূল শিকড় প্রোথিত মুক্তিযুদ্ধের মাটিতে, যদিও দলটি কট্টর চেতনাপন্থি নয়, বরং অনেকটাই সমন্বয়বাদী। রিকনসিলিয়েশন তথা জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে এবং কিছুটা কৌশলগত কারণে প্রতিষ্ঠালগ্নে ইনক্লুসিভ নীতি গ্রহণ করেছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অনেককে তখন দলে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো বিএনপির সমন্বয়বাদী নীতির অপব্যাখ্যা করেছে, যদিও শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও একজন বড় সমন্বয়বাদী ছিলেন। তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, জুলফিকার আলি ভুট্টোকে দাওয়াত করে বাংলাদেশে এনেছিলেন, জাতীয় স্মৃতিসৌধেও নিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ সাহেব সব বাধা উপেক্ষা করে পিন্ডিতে ইসলামিক কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন। তাহলেও আওয়ামী লীগ কোটারি স্বার্থে বিএনপিকে পাকিস্তানপন্থি দল বলে অপপ্রচার চালিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পরও জাতীয়তাবাদী দল সমন্বয়বাদী নীতি পরিহার করেনি। কিন্তু যারা এখনো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব মেনে নিতে পারেননি এবং যারা নীতিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাসের সঠিক সিদ্ধান্ত বলে স্বীকার করেন না, তারা ভালো করেই জানেন যে, বিএনপি মূলগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ধারণকারী একটি দল। এ দলের জাতীয়তাবাদী নীতির ভিত্তি হলো মুক্তিযুদ্ধ। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক এবং একজন সেক্টর কমান্ডার। এ দল জীবন থাকতে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ম্লান হতে দেবে না। সে কারণেই দলটি দেশের অফিশিয়াল নাম পরিবর্তন ও সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। দলটি বাহাত্তরের সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব মুছে দিয়ে ২০২৪ সালের দুনিয়া কাঁপানো গণ অভ্যুত্থানকে প্রতিস্থাপিত করারও পক্ষপাতী নয়। এমনকি গণতান্ত্রিক নীতি বিসর্জন দিয়ে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষেও নয় বিএনপি। এমতাবস্থায় যারা মুক্তিযুদ্ধকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে চান তারা বিএনপিকেই হয়তো প্রধান বাধা মনে করছে।
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকট ও চাপের মধ্যে রয়েছে। একদিকে মাঠপর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অন্যদিকে প্রশাসনিক বাধা-সব মিলিয়ে দলের সাংগঠনিক শক্তি বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যেও তারেক রহমানকে ঘিরে দল যে নেতৃত্বকাঠামো বজায় রেখেছে, তা ঈর্ষণীয়। তাই এ নেতার ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রয়াস কেবল ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়-এটি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক শক্তিকে হীনবল করে দেওয়ার চেষ্টা।
এ পরিস্থিতিতে স্পষ্টতই প্রতিফলিত হচ্ছে যে কোনো মূল্যে বিএনপি ও তারেক রহমানকে নিষ্ক্রিয় বা শক্তিহীন করে দিয়ে বিলম্বিত একতরফা নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার একটি পরিকল্পনা নিয়ে হয়তো এগোচ্ছে সেই মহলটি। নির্বাচনের আড়ালে একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে, যেখানে কেবল দেখানোর উপকরণ হিসেবে গণতন্ত্র থাকলেও তার রূপ, রস ও গন্ধ থাকবে না। এবং তখন বিনা বাধায় ইতিহাস রিসেট করা যাবে। কিছু কিছু কাজের মধ্য দিয়ে সেই আলামতও দেখছে সচেতন মহল। সাম্প্রতিককালের গোপালগঞ্জকাণ্ড সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছিল কি না, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। এনসিপি জেলায় জেলায় সমাবেশ কর্মসূচি করেছে। অন্য কোনো জেলার নাম করে মার্চ করা হয়নি। কিন্তু মার্চ টু গোপালগঞ্জ কেন বলা হলো? এর মধ্যে কি কোনো উসকানি ছিল? মুজিববাদের কবর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। মুজিববাদকে তারা কোথায় পাবেন? মুজিববাদের কবর তো হয়ে গেছে ১৯৭৫ সালেই। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ তো ভুল করেও কোনো দিন মুজিববাদের সেøাগান দেয়নি। শেখ হাসিনার আমলে যা ছিল তাকে বড়জোর বলা যায় হাসিনাবাদ। তাহলে যে মুজিববাদের অস্তিত্ব নেই সেই মতবাদের কবর দিতে চাওয়া কেন? এগুলো বিভ্রান্তিকর।
এসব কর্মকাণ্ড জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের পথে বিঘ্ন তৈরি করছে। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত গৌরব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দয়া করে গণতন্ত্রের পথ সহজ করুন। বাঁকা পথে শেষ পর্যন্ত গ্লানি ছাড়া আর কোনো কিছুই অর্জন করা যায় না। ভালো কিছু তো নয়ই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক