কারও ব্যাপারে কোনো অভিযোগ পেলে সেটা যাচাইবাছাই ছাড়া গ্রহণ ও প্রচার করা ইসলামে নিষিদ্ধ, কঠিন হারাম। মহান আল্লাহ ইসলাম নামের যে শাশ্বত জীবনবিধান আমাদের দিয়েছেন, সেখানে ধারণাবশত কারও ওপর আক্রমণ করা দূরে থাক, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারও ব্যাপারে মন্দ ধারণা করাও নিষেধ। মহান আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা অধিকাংশ ধারণা থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয় কিছু ধারণা গুনাহ (হুজুরাত ১২)। আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তোমরা সে বিষয়ের অনুসরণ করো না (সুরা বনি ইসরাইল ৩৬)। সন্দেহবশত কারও ব্যাপারে অহেতুক ধারণা করাই যদি অপরাধ হয়, তবে বুঝেশুনে, সজ্ঞানে নির্দোষ ব্যক্তিকে জঙ্গি হিসেবে ফাঁসিয়ে দেওয়া কত বড় জঘন্য অপরাধ, তা সহজেই অনুমেয়।
সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী গত এক শতাব্দীতে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় যে মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, সেটা হলো ইসলাম মানে সন্ত্রাসবাদ এবং মুসলমানরা জঙ্গি। গত এক শতাব্দীতে পরাশক্তিগুলোর অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে বড় মিথ্যা এটাই। আপনি যদি ইউরোপ-আমেরিকায় ভ্রমণ করে থাকেন, আপনার তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকার কথা। কেবল মুসলমান নাম থাকার কারণেই সেসব দেশ ভ্রমণে আপনাকে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। এটা তাদের ইসলামো ফোবিয়ার ফল। একটা সময় আমাদের দেশের মাটিকেও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এ দেশের ধার্মিক শ্রেণিকে নানা সময়ে জঙ্গি তকমা দেওয়া হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করে সামনে ফাজায়েলে আমল, হেকায়েতে সাহাবা, কোরআনের অনুবাদ রেখে ছবি তুলে বলা হয়েছে এরা জঙ্গি। এদের কাছে জিহাদি বই পাওয়া গেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী কোরআন যদি জঙ্গিবাদের বই হয়-তবে আমরা সবাই জঙ্গি। কারণ আমাদের প্রত্যেকের বাসায় কোরআন আছে। আমরা সবাই কোরআন পড়ি। এদের খুঁটিতে এতটাই জোর যে ন্যূনতম সাবধানতার তোয়াক্কাও এদের করতে হয়নি। হাতের কাছে যা পেয়েছে তাকেই এরা জঙ্গিবাদের বই হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। এগুলো যে নাটক ছিল, বর্তমানে পুলিশের অনেক দায়িত্বশীল বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় জঙ্গি দমনের নামে এ দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর কমপক্ষে ১০ থেকে ১২টা বিভাগ পরিচালিত হয়। এদের প্রধান কাজই হচ্ছে তথাকথিত জঙ্গি ধরা। একদিকে দায়িত্বশীলরা বলছেন, এ দেশে কোনো জঙ্গি নেই, অপরদিকে জঙ্গি দমনের নামে এতগুলো টিম! এ দেশে খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি দুর্নীতির মতো বড় বড় অপরাধ প্রতিনিয়ত সংঘটিত হয়, যা দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্পেশাল কোনো ফোর্স নেই। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনশক্তির অভাবে সাধারণ জনগণ পর্যাপ্ত সেবা পায় না। অথচ কথিত জঙ্গি ধরার নামে এতগুলো টিম কাজ করছে। মূলত পশ্চিমাদের খুশি করার জন্য তাদের লিখিত চিত্রনাট্য অনুযায়ী জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করাই এদের কাজ। এর পেছনে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। এটা এ দেশের মানুষকে দীনবিমুখ করার পাঁয়তারা। কারণ পশ্চিমারা জানে, এ দেশের মানুষ ধার্মিক, তারা আলেমদের ভালোবাসে, আলেমদের কথা শোনে; তাই জনগণের হৃদয় থেকে ইসলাম ও আলেমদের ভালোবাসা মুছে দেওয়ার জন্য তারা ইসলামপন্থিদের জঙ্গি বানানোর নাটক করে। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হয়। আলেমদের ব্যাপারে তাদের কুধারণা তৈরি হয়। একসময় তারা দীন থেকে বিমুখ হয়ে পড়ে। বিগত সময়ে জঙ্গিনাটক বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে এসেও যে সেই পুরোনো নাটক আবার আমাদের দেখতে হবে, তা আমরা কেউই হয়তো ভাবিনি। কয়েক দিন আগে কয়েকজন তরুণ আলেম-দাঈর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ আনা হয়েছে। কেন তাদের চরিত্রে জঙ্গিবাদের কালিমা লেপন করা হলো, এর কারণ আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। কারণ তারা এমন যুবক, যাদের দীনি লেখালেখি, গবেষণা ও দাওয়াহ পশ্চিমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। ফলে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই মূলত এই নতুন জঙ্গি নাটকের অবতারণা।
এই জঙ্গি জঙ্গি খেলার খপ্পরে পড়ে অনেক সময় জিহাদের ব্যাপারেও আমাদের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। অথচ তারা ক্রুসেড বা খ্রিস্টান ধর্মযুদ্ধের ঘোষণা দিলে সেটাকে কেউ সন্ত্রাসবাদ মনে করে না। জিহাদ ইসলামের মহান বিধান। তবে এর প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও শর্ত রয়েছে। নিরপরাধ মানুষ মারার নাম জিহাদ নয়। শুরু থেকেই পশ্চিমারা জিহাদকে সন্ত্রাস আখ্যা দিচ্ছে। কিন্তু জিহাদ সন্ত্রাস নয়। জিহাদ আল্লাহর মহান বিধান এবং মজলুমের মুক্তির পয়গাম। আর সন্ত্রাস মজলুমকে পিষে মারার অস্ত্র। পশ্চিমা গোষ্ঠী জিহাদকে বিতর্কিত করার জন্য নিজেদের অর্থায়নে মুসলমানদের মাঝে বিভিন্ন দল তৈরি করে তাদের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে আর বিশ্ববাসীকে জানাচ্ছে জিহাদ এভাবেই নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে বলে। এসব ষড়যন্ত্রে আমরাও অনেক সচেতন মুসলমানও বিভ্রান্ত হয়ে যায়।
জুমার মিম্বর থেকে বয়ান
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ