যশোর সদর উপজেলায় ভৈরব নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে একটি আধুনিক রিসোর্ট-ধাঁচের খামারবাড়ি। চোখজুড়ানো এ খামারটি যেন প্রকৃতির কোলে এক শিল্পীত ছায়া, যেখানে কৃষি, ব্যবসা এবং নান্দনিকতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। এর উদ্যোক্তা অটোপার্টস ব্যবসায়ী এজাজ উদ্দিন টিপু। তিনি শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছেন কৃষির এক নতুন দিগন্ত। শুরুটা ছিল নিছক শখ থেকে, পারিবারিক কোরবানির গরু লালনপালনের আগ্রহ থেকেই। কিন্তু সেই শখের বীজে এখন বাণিজ্যিক স্বপ্নের ডালপালা বিস্তার করেছে।
গত এপ্রিলে যশোরের এক পালবাড়িতে কাজ করতে করতে চোখে পড়ল পাশের এ খামারবাড়িটি। আগ্রহ নিয়ে খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল বিস্তারিত। খামারে উপস্থিত ছিলেন উদ্যোক্তা এজাজ উদ্দিন টিপু। তাঁর খামারটি এখন শুধু গবাদিপশু পালন বা ফল চাষের ক্ষেত্র নয়, বরং এটি হয়ে উঠছে আধুনিক কৃষির এক পরীক্ষণ ক্ষেত্র। বড় বড় বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে বেড়ে উঠছে চুইঝালের গাছ। একদিকে জমির সৌন্দর্য বাড়ছে, অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। বলছিলেন, চুইঝালের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। বাড়ছে এর বাণিজ্যিক গুরুত্বও। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও এর চাহিদা আছে। তাই চুইঝাল নিয়ে তাঁর রয়েছে বিশদ পরিকল্পনা। খামারের পাশে চোখে পড়ে কাঠের তৈরি একটি বিদেশি ধাঁচের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। টিপু জানালেন, এ কাঠের বাড়িটির নান্দনিক উপস্থাপনের পেছনে রয়েছে পর্যটনভিত্তিক কৃষির পরিকল্পনাও। ভাবনাটা পরিষ্কার, এ খামারটি যেন হয় ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক কৃষিভিত্তিক অবকাশযাপন কেন্দ্র।
বাংলাদেশের কৃষি খাতে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা এখন আর নতুন কোনো খবর নয়। গত কয়েক দশকে এ প্রবণতা ক্রমেই বেড়েছে। যে উদ্দেশ্যে একজন সফল ব্যবসায়ী খাদ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করেন, তা শুধু মুনাফার জন্য নয়, আছে নিরাপদ খাদ্যের তাগিদ আর মনের ভিতরে কৃষি প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। এজাজ উদ্দিন টিপুর পারিবারিক এ খামার সেটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গরুর খামারের অংশটি বেশ আধুনিক। খামারটিতে বর্তমানে লালনপালন করা হচ্ছে ব্রাহামা, শাহিওয়াল ও দেশি জাতের অর্ধশতাধিক গরু। গরু দেখভালের জন্য রয়েছে প্রশিক্ষিত কর্মী ও আধুনিক অবকাঠামো। কোরবানি ঘিরে বেশ ভালো বাণিজ্য হয় তাঁর। গত ঈদে ভালো বেচাকেনা হয়েছে। সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ৬ লাখ টাকার গরু বিক্রি হয়। গরু কেনা ও পালনে ৫০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ ছিল। বিনিয়োগকৃত অর্থ লাভসহ উঠে এসেছে। ভবিষ্যতে খামারটিকে আরও সম্প্রসারণের ইচ্ছা আছে। খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে ৭ তরুণের। কর্মীরা জানান, গরুগুলোকে কাঁচা ঘাস, গমের ভুসি, খৈল, চালের গুঁড়া, দেশীয় খাবার দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট করা হয়। প্রতিদিন গোসল করানো হয়। ফ্যানের নিচে রাখা হয়। সব মিলিয়ে তাঁদের সন্তানের মতো পরিচর্যা করা হচ্ছে। নদীর তীর ধরে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফলের বাগান। আম, ড্রাগন ফল, মাল্টা, পেয়ারা, কমলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের উদ্ভিদ এখানে জায়গা করে নিয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা যুক্ত হচ্ছেন কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে। শিল্পপতিরা কৃষি খাতে যুক্ত হওয়ায় শুধু পুঁজির জোগানই ঘটে না, সেই সঙ্গে আসে প্রযুক্তি, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার আধুনিক ধারা। আধুনিক যন্ত্রপাতি, উন্নতমানের বীজ ও প্রাণিসম্পদের জাত উন্নয়নের পেছনে বিনিয়োগ করার সক্ষমতা তাঁদের আছে। আর এ বিনিয়োগ কৃষিকে করে তোলে আরও পেশাদার ও দক্ষ। চুক্তিভিত্তিক চাষ, হাইড্রোপনিকস, স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি, অর্গানিক ফার্মিং এসব ধারণা তখন আর কেবল থিওরি থাকে না, বাস্তবে রূপ পায়। ব্যবসায়ীরা যখন খাদ্য উৎপাদনে সম্পৃক্ত হন তখন তৈরি হয় একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্যালু চেইন। উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, বিপণন ও রপ্তানি সমগ্র ব্যবস্থায় পেশাদারি বাড়ে। এর মাধ্যমে একটি খাদ্যপণ্যের গুণগত মান যেমন বজায় থাকে, তেমনি কৃষকের জন্য তৈরি হয় স্থায়ী বাজার। একদিকে অপচয় কমে, অন্যদিকে ভোক্তা পায় নিরাপদ খাদ্য। এ ছাড়া ব্র্যান্ডসচেতন ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্যের মানের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, কারণ সেটিই তাঁদের ব্যবসার ভিত্তি। ফলে দেশের ভোক্তারা পায় মানসম্পন্ন, নিরাপদ এবং ট্রেসযোগ্য খাদ্যপণ্য, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল দেশীয় বাজার নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার কথা মাথায় রেখেও এ খাত এখন পরিচালিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গ্যাপ (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস) সার্টিফিকেশনের আওতায় অনেকে আম উৎপাদনের দিকেই ঝুঁঁকছেন। এভাবে কৃষিপণ্যের বৈদেশিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হলে দেশের রপ্তানি আয়ও বাড়বে। দেশের কৃষি অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
তবে এ উল্লম্ফনের মাঝেও কিছু সতর্কতা জরুরি। করপোরেট কৃষির বিস্তার যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়, তবে ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য তা প্রতিযোগিতামূলক চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এ ব্যবস্থায় ছোট চাষিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ, কৃষক সহায়তা কেন্দ্র, কো-অপারেটিভ মডেল ইত্যাদির মাধ্যমে করপোরেট কৃষি এবং ক্ষুদ্র কৃষকের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। তা ছাড়া পরিবেশ রক্ষাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার, জলাশয় দখল, এক ফসলি জমিতে বহুমুখী চাষাবাদ দেওয়ার মতো সমস্যাগুলো প্রতিহত করতে করপোরেট খাতকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষির দিকে নজর দিতে হবে। এজাজ উদ্দিন টিপুর মতো অনেক উদ্যোক্তাই এখন কৃষিকে কেবল খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র নয়, বরং জীবনের সঙ্গে যুক্ত এক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা হিসেবে দেখছেন। শহরের ক্লান্ত মানুষজনকে প্রকৃতির মাঝে নিয়ে আসার পাশাপাশি, এখানে তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থান। খামারে কাজ করছেন স্থানীয় যুবকরা, কৃষিপণ্য সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণে যুক্ত হচ্ছে আশপাশের মানুষজন। এটি একটি ‘গ্রাম-নগর সংযোগ’-এর আধুনিক রূপ, যা দেশের ভবিষ্যৎ কৃষির দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
কৃষিকে ঘিরে যে নতুন চিন্তা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে, এজাজ উদ্দিন টিপুর এ খামার তার অন্যতম উদাহরণ। এটি দেখায়, কীভাবে শখের বীজ থেকে জন্ম নিতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ ও পেশাদার উদ্যোগ। এখানে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হৃদয়ের টান। আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মিলেছে দেশীয় জ্ঞানের মিশ্রণ। ব্যবসায়িক মুনাফার পাশাপাশি আছে সামাজিক দায়বদ্ধতা, আর আছে পরিবেশের প্রতি সচেতনতা। সার্বিকভাবে বলা যায়, কৃষির করপোরেটায়ন খারাপ কিছু নয়, যদি এটি সঠিকভাবে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং পরিবেশ ও ন্যায্যতা বজায় রেখে পরিচালিত হয়। কৃষিকে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও পেশাদার করার জন্য করপোরেট খাতের সম্পৃক্ততা প্রয়োজনীয়ই বটে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন চর্চা আছে। তবে আমাদের মতো দেশে সঙ্গে সঙ্গে দরকার নীতি সহায়তা, কার্যকর নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষুদ্র চাষিদের অধিকার রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার। তাহলেই সম্ভব হবে এক সমৃদ্ধ, নিরাপদ এবং টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব