রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় সাইকেল লেন চালু হয়েছিল নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে। তখন বলা হয়েছিল, ঢাকার মানুষকে ধীরে ধীরে পরিবেশবান্ধব পরিবহনের দিকে নেওয়া হবে। সাইকেল চালকদের জন্য নিরাপদ আলাদা পথ থাকলে তারা আর মূল সড়কের দ্রুতগতির যানবাহনের ঝুঁকিতে পড়বেন না। প্রথম কয়েক মাস অনেকে আশা করেছিলেন, শহরের ভিড় কমাতে এটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন খুব বেশিদিন টেকেনি।
উদ্বোধনের মাত্র এক বছরের মধ্যেই লেনটির ওপর দখল বাড়তে শুরু করে। ২০২১ সাল থেকেই দোকানের টেবিল, চুলা, ভ্যানের চাকা, নির্মাণসামগ্রী, কাঠের স্তূপ, লোহার রড, যা কিছু সামনে পেয়েছে তাই লেনের ওপর রাখা হয়েছে। প্রথম দিকে কেউ কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২০২১ সাল থেকেই বিভিন্ন দপ্তরের গাড়ি নিয়মিত লেনে রাখা শুরু হয়। কেউ বাধা দেয়নি, কেউ তদারকি করেনি। ফলে দখলের দৌড়ে যুক্ত হয় ভ্যান, রিকশা, খাবারের দোকানসহ ভাসমান চায়ের দোকান।
এখন সাইকেল লেনটির কোনো অংশেই আর সাইকেল চালানোর জায়গা নেই। হাঁটতেও কষ্ট হয়। গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে ছোটখাটো ব্যবসা সবই চলছে। আগারগাঁওয়ের সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটলে বোঝা যায় না যে, এখানে কখনো সাইকেলের জন্য আলাদা লেন ছিল। সাদা-হলুদ রঙের চিহ্ন, সাইকেলের আঁকা পথ সব মুছে গেছে দখলের নিচে। ব্যক্তিগত গাড়ি, সরকারি অফিসের মাইক্রোবাস রাখা সড়কে। কোথাও দোকান গড়ে উঠেছে আবার কোথাও নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ।
সরেজমিন দেখা যায়, লেনের শুরুতেই খাবারের দোকানগুলো স্থায়ী রূপ নিয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আগুন জ্বলে, ভাজাভুজির গন্ধ ভাসে বাতাসে। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, লেনের ওপর ইট, কাঠ রাখা হয়েছে। অনেকে অস্থায়ী নার্সারিও গড়ে তুলেছেন। এমন দৃশ্য দেখে বোঝাই যায় না, এখানে কখনো সাইকেল লেন ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ২০২০ সালে যখন এটি চালু হয়, তখন কিছুদিন ভালোই ছিল। সকাল-বিকাল সাইকেল চালিয়ে যেতেন অনেকেই। শিশু কিশোররা সাইকেল নিয়ে আনন্দ করত। কিন্তু দখল হয়ে গেছে এই সাইকেল লেন। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না।
ইউনিয়ন সাইক্লিস্ট অব বাংলাদেশের অ্যাডমিন শামীম মিশু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকায় সাইকেল চালানো কঠিন। বিশ্বের অনেক দেশেই সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা রাস্তা আছে। আমাদের দেশেও যদি সাইকেলের জন্য আলাদা লেন করা যায় তাহলে সেটা খুব ভালো হয়। এতে দুর্ঘটনাও কমবে। আগারগাঁও সাইকেল লেন দখল হয়ে গেছে বলে শুনেছি। এটা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছাড়া আর কিছুই না।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকায় যে কোনো ফাঁকা জায়গাই দখলের ঝুঁকিতে থাকে। সাইকেল লেনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। উদ্বোধনের পর থেকেই এটি যেন অভিভাবকহীন ছিল। কেউ নজরদারি করেনি, কেউ রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। ফলে এক বছরের মধ্যেই দখল শুরু হয়। এখন তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাইকেল লেন কেবল একটি সরকারি প্রকল্প নয়, এটি ছিল শহরের পরিবহন চিন্তায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা। কিন্তু এই শহরে নতুন উদ্যোগ টিকিয়ে রাখার মানসিকতা খুব কম। পরিকল্পনা যতই আধুনিক হোক, যদি দায়িত্বশীলভাবে তা রক্ষা করা না হয়, তাহলে এর শেষ পরিণতি এমনই হয়।’