বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। হাতিরঝিলের এফডিসি-কারওয়ান বাজার ঘাটে ওয়াটার ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষায়। উদ্দেশ্য লিংক রোড। সকাল সাড়ে ৮টায় এসে টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে আছেন। এর আগে একবার এই স্টেশনে ওয়াটার ট্যাক্সি এলেও তার ভাগ্য হয়নি ওঠার। কারণ তার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও ৩০ জন। হাতিরঝিলে ওয়াটার ট্যাক্সি চালু হওয়ার পর থেকেই এতে যাতায়াত করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিংয়ে কর্মরত তরিকুল।
তরিকুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অফিসগামী মানুষের কারণে সকাল বেলা ওয়াটার ট্যাক্সিতে অনেক চাপ থাকে। এজন্য অপেক্ষা করতে হয়। সবাই চায় কম সময়ে জ্যাম এড়িয়ে যাতায়াত করতে। এ কারণে এফডিসি ঘাট থেকে যারা বাড্ডা ও গুলশানে যান তারা অনেকেই ওয়াটার ট্যাক্সিতে করে যাতায়াত করেন। এতে সময় বাঁচে ও জ্যামেও বসে থাকতে হয় না।
শুধু তরিকুল ইসলামই নয়, ঢাকার বুকে পানিপথে নানান পেশার মানুষের বাহন হয়ে উঠেছে এ ওয়াটার ট্যাক্সি। মগবাজার থেকে মেরুল বাড্ডায় অবস্থিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন শিক্ষার্থী নাদিম কাদির। বাসে গেলে তার ঘণ্টার ওপরে সময় লাগে। ওয়াটার ট্যাক্সি হয়ে গেলে খুব কম সময়ে পৌঁছাতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জানান, বাসে বা সিএনজিতে যাওয়ার চেয়ে ওয়াটার ট্যাক্সিতে গেলে সময় ও টাকা দুটিই কম লাগে।
তরিকুল ও নাদিম কাদিরের মতো শত শত মানুষের কাছে ওয়াটার ট্যাক্সি একটি জনপ্রিয় বাহন। এই সেবা চালুর পর থেকে বাড্ডা, গুলশান, রামপুরা, খিলগাঁওসহ নগরীর পূর্বাংশের মানুষ যানজটের ঝক্কি এড়িয়ে কারওয়ান বাজার, মগবাজার, দিলু রোড, ইস্কাটন, বাংলামোটর, তেজগাঁও এলাকায় সহজে যাতায়াত করতে পারছেন।
২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে হাতিরঝিলে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিসের উদ্বোধন করা হয়। প্রথমে দুটি রুটে এই পরিষেবা চালু করা হয়। পরে আরেকটা রুট চালু করা হয়েছে।
এফডিসি ঘাট থেকে রামপুরা ঘাট। এই রুটে যাত্রীরা মাত্র ২৫ টাকায় যাতায়াত করতে পারেন। এটি বিশেষত রামপুরা, বনশ্রী, আফতাবনগর এবং মালিবাগ-মৌচাক এলাকার যাত্রীদের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। সড়কপথে যানজটের কারণে এ দূরত্ব পার হতে প্রায়শই দীর্ঘ সময় লাগে, কিন্তু ওয়াটার ট্যাক্সি ব্যবহার করে দ্রুত এবং স্বাচ্ছন্দ্যে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব। করিম গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এ ওয়াটার ট্যাক্সি চালান।
এফডিসি ঘাট থেকে গুদারা ঘাট (গুলশান ১) : এই রুটে যাতায়াত খরচ ৪০ টাকা। এটি গুলশান ১ ও ২, বারিধারা এবং বনানী এলাকার যাত্রীদের জন্য খুবই উপকারী। যারা গুলশান থেকে কারওয়ান বাজার বা এফডিসি এলাকায় কাজ করেন, তাদের জন্য এটি একটি সহজ এবং সময়-সাশ্রয়ী বিকল্প।
যাত্রীদের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে এবার গুদারাঘাট থেকে পুলিশ প্লাজায় যাতায়াতের জন্য নতুন একটি রুট চালু করেছে কর্তৃপক্ষ। এ রুটে আসনপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা।
প্রতিটি ওয়াটার ট্যাক্সিতে প্রায় ৩০-৪০ জন যাত্রীর ধারণক্ষমতা রয়েছে। এগুলোর নকশা করা হয়েছে আরামদায়ক এবং নিরাপদ ভ্রমণের জন্য। প্রতিটি ট্যাক্সিতে যাত্রীদের জন্য লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা আছে। এফডিসি কাউন্টার মাস্টার নয়ন জানান, সকালে ও বিকালে যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। তিনি জানান, এ রুটে ১৫টি ট্যাক্সি চললেও বর্তমানে ৫ নষ্ট। ১০টি ট্যাক্সি চলমান রয়েছে। জেটি ইনচার্জ জয়নুল আবেদীন বলেন, হাতিরঝিলে পানির দুর্গন্ধের কারণে পর্যটক কম আসেন। পানিসংকট সমাধান হলে পর্যটক বাড়বে।
হাতিরঝিল ঘুরে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরাসহ প্রেমিক-প্রেমিকারাও এসেছেন ওয়াটার ট্যাক্সিতে বসে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রেমিক জুটি একে অপরের ঘাড়ে মাথা রেখে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছেন। কেউ কেউ ওয়াটার ট্যাক্সিতে ওঠার স্মৃতি ধরে রাখতে সেলফি তুলতেই ব্যস্ত।
হাতিরঝিলের ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যদি এর রুটগুলো আরও বাড়ানো হয় এবং ভাড়াকে আরও সাশ্রয়ী করা যায়, তাহলে এটি আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। পাশাপাশি রাতে ভ্রমণের জন্য পর্যাপ্ত আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা গেলে তা পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হবে। এই ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস যদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি ভবিষ্যতে ঢাকার যানজট নিরসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
হাতিরঝিলের ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ঢাকার নগরজীবনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এটি শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, বরং শহরের সৌন্দর্য ও আধুনিকতার একটি প্রতীক। এর সফলতার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে ঢাকার অন্যান্য জলাশয় বা নদীপথেও একই ধরনের সার্ভিস চালু করা যেতে পারে; যা সামগ্রিকভাবে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে সহায়ক হবে।