জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিসহ পাঁচ দফা দাবি ১৬ নভেম্বরের মধ্যে মেনে না নিলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আন্দোলনরত আট দল। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটের দাবিতে অনড় বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের যৌক্তিকতা নেই, সময়ও নেই। সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছানোর আহ্বান জানানো হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। আট দলের কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে ছাত্রদের আলোচিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। সবমিলিয়ে দেশের রাজনীতি এখন সংঘাতের পথে।
গণভোট কবে হবে, সেই প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতপার্থক্যের বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল গুলশানে বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, গণভোট আগে হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা এখন নেই, সময় নেই। তাছাড়া প্রয়োজনও নেই। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যদি আমরা একটা ছোট্ট ব্যালটে এই গণসম্মতিটা নিতে পারি, সেটাই হবে সবচেয়ে যৌক্তিক, প্রাসঙ্গিক, গ্রহণযোগ্য এবং অতিরিক্ত ব্যয় হবে না। তিনি বলেন, সরকার প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বৈত ভূমিকায় স্বার্থের সংঘাত হচ্ছে। এখানে ক্লাস অব ইন্টারেস্ট আছে। এ সরকার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে সহযোগিতায় থাকব, ভোটে অংশগ্রহণ করব, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করব। কিন্তু সেই সরকারের প্রধান হিসেবে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে যে সুপারিশগুলো সরকারের কাছে দেওয়া হলো, সেখানে অনেকটা জুলাই জাতীয় সনদ যেভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার থেকে বহুদূরে সরে গেছে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান গতকাল বলেছেন, অবিলম্বে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং ওই আদেশের ওপর আগামী নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট আয়োজন করাসহ পাঁচ দফা ১৬ নভেম্বরের মধ্যে মেনে নিতে হবে। নইলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক সংসদ সদস্য ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ গতকাল মহেশখালীতে এক কর্মসূচিতে বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। আদেশ জারি করে জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতেই হবে। ড. হামিদ আযাদ সরকারের উদ্দেশে বলেন, দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না, তাই দ্রুত সময়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও নির্বাচনের পূর্বে গণভোটের আয়োজন করার আহ্বান জানান।
এনসিপি মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আট দলের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বলেন, আপনাদের পাশে আছি। দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরবেন না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে ককটেল সন্ত্রাস। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আর গণভোটের সময় নিয়ে ঐকমত্যে সুর মিলবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। গণভোট প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াতের বিপরীতমুখী অবস্থানে রাজনীতি সংঘাতের মুখে ফেলতে পারে। যা নির্বাচনকে ব্যাহত বা পিছিয়ে দিতে পারে। এরই মধ্যে আলোচনার টেবিলে বসতে জামায়াতের আহ্বান নাকচ করেছে বিএনপি। তবে রাজপথের দখল নিতেও মরিয়া উভয় দল। যা উত্তপ্ত সময়েরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। দুই দলের দিক থেকেই আক্রমণাত্মক বক্তব্য আসছে। যা সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। রাজনীতির ময়দানে ঐক্য যেন মরীচিকার মতো। আলোচনার টেবিল ছেড়ে বিতর্কেই সময় পার করছে রাজনৈতিক দলগুলো। এ নিয়ে মাঠে-ময়দানে, সেমিনারে চলছে কথার লড়াই, পাল্টাপাল্টি মন্তব্য। নিজেদের অনড় অবস্থানের পক্ষে এভাবেই সওয়াল করছেন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা।
পিআর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে? গণভোটের দিনক্ষণই বা কবে? এসব প্রশ্নে আলোচনা ছেড়ে রাজপথে নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলো। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের পক্ষে অবস্থান জামায়াতের, আর ঠিক উল্টো অবস্থানে বিএনপি। যেন এক বিন্দুতে পৌঁছানো পাহাড় ডিঙানোর মতোই কঠিন কাজ। রাজনৈতিক দলগুলোর রোজকার কথায় স্পষ্ট অনৈক্যর সুর। এমন বাস্তবতায় শুরু হয়ে গেছে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ডামাডোল। তবে কি নির্বাচনি রেলে চেপে গন্তব্যে পৌঁছানোর সংকল্পে ঐক্যের সুর বাজবে না? এমন প্রশ্নে বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের চেয়ে জনগণের চাওয়াকেই এগিয়ে রাখতে হবে রাজনীতিবিদদের। পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতাদের শব্দচয়নে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কথায় কথায় আপনি রাস্তায় যাবেন। এখন অন্য দল যদি তার প্রতিবাদে আবার রাস্তায় যায়, তাহলে কী হবে, সংঘর্ষ হবে না? তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ সাংঘর্ষিক রাজনীতি দেখতে চায় না, স্থিতিশীলতা দেখতে চায়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর চরমোনাই বলেন, আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চাই। এটি অবশ্যই অনুষ্ঠিত হতে হবে। জুলাই সনদকে যদি আইনি ভিত্তি দেওয়া না হয়, তবে নির্বাচন অবৈধ হবে।
তিনি বলেন, গণভোটের দাবি কোনো একটি দলের নয়। এরপর আমরা এমন আন্দোলন শুরু করব, সরকার নির্বাচনের আগে গণভোট নিতে বাধ্য হবে।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, দলগুলোকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এখন সরকারই তাদের দায়িত্ব ও এখতিয়ারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারের দরজা সব দলের জন্যই খোলা।