গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়কের বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের নকশায় ভুলের কারণে এর সুফল পাচ্ছেন না এই রুটে যাতায়াতকারীরা। যানজটে নাকাল হচ্ছেন গাজীপুরবাসী। এ পথে যাতায়াতকারী দূরপাল্লার যাত্রীরাও নিয়মিত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। দিনের বেশির ভাগ সময়ই যানজট লেগে থাকে বিআরটিতে ওঠার র্যাম্পগুলোতে।
গাজীপুর চৌরাস্তা, ভোগড়া বাইপাস, গাজীপুরা, চেরাগ আলী এবং উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনের সড়কে বিআরটিতে ওঠার র্যাম্পের মুখে ট্রাফিক জ্যামে প্রতিদিন উন্নয়নের ভোগান্তি পোহাতে হয়। আবুল কালাম প্রতিদিন গাজীপুরা বাসস্ট্যান্ড থেকে অফিস করতে যান রাজধানীর পল্টনে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, বিআরটি যতটা সুফল বয়ে আনার কথা ছিল তার সুফল মিলছে না। প্রকল্পটি যদি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো হতো তবে গাজীপুরবাসীর জন্য এটি আশীর্বাদ হতো। ঢাকা থেকে এই রুটে চলাচলকারী টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুরের দূরপাল্লার বাসগুলো ওপর দিয়ে চলাচল করতে পারত। ফলে গাজীপুরবাসী নিচের চার লেন সড়ক ফাঁকা পেতেন। এতে গাজীপুরের দীর্ঘদিনের যে ট্রাফিক জ্যামের ভোগান্তি তা অনেকটাই উপশম হতো।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দীর্ঘ বিআরটি প্রকল্পটি যেন বন্ধুর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু। হঠাৎ গাড়িগুলোকে ওপরে উঠতে হচ্ছে আবার হঠাৎ নিচে নামতে হচ্ছে।
উত্তরার বিএনএস সেন্টার থেকে গাজীপুরগামী যানবাহনগুলো বিআরটি ধরে একটানে টঙ্গীর কলেজ গেট পর্যন্ত যেতে পারে। কলেজ গেট থেকে আবার নিচের সড়ক ব্যবহার করতে হয়। অনেক সময় দূরপাল্লার বাসসহ লোকাল বাস এবং অন্যান্য যানবাহন টঙ্গীর স্টেশন রোড, চেরাগ আলী, কলেজ গেট র্যাম্প ব্যবহার করে কখনো নিচে নামছে আবার উল্টো পাশের র্যাম্প ধরে ঢাকাগামী যানবাহনগুলো ওপরে উঠছে। এতে র্যাম্পে ওঠা-নামার সময় যানজট দেখা দিচ্ছে।
এদিকে, উত্তরা থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত উড়ালসড়ক চার লেন থাকলেও চেরাগ আলী থেকে কলেজ গেট পর্যন্ত সড়ক দুই লেনের। ফলে কলেজ গেট এলাকায় বিআরটি থেকে ওঠা কিংবা নামার মুখে বিপরীত পাশের গাড়িগুলোকে চলাচল করতে দেওয়ার জন্য এক পাশের সড়ক কিছুক্ষণ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে দীর্ঘ এলাকায় তৈরি হচ্ছে যানজট।
আবার চেরাগ আলী চৌরাস্তার মুখে নির্মিত র্যাম্পের কারণে দিনের বেশির ভাগ সময় এ এলাকায় চতুর্মুখী যানজট লেগে থাকে। দুই মিনিটের রাস্তা পেরোতে কখনো কখনো আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। অফিস সময়ে এ যানজট আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
তাছাড়া লোকাল এবং দূরপাল্লার বাসগুলো যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করে। বিশেষ করে লোকাল বাসগুলো যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলে কিংবা নামায়। জটিল সড়ক ব্যবস্থা এবং যানবাহনের অতিরিক্ত চাপে জর্জরিত এ সড়কে এসব অব্যবস্থাপনার কারণে যখন তখন যানজট লেগে যায়। এছাড়াও এই সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্পকারখানা। কারখানার মালপত্র আনা-নেওয়ার বড় বড় কাভার্ড ভ্যান এবং ট্রাক মূল সড়ক থেকে শিল্পকারখানায় ঢোকা কিংবা মূল সড়কে উঠতে ভোগান্তির শিকার হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভুল নকশার কারণে এ প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। সংশোধনী আনতে গেলে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। ফলে এ প্রকল্পের শতভাগ সুফল পাওয়াটা এখন অকল্পনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়কে বাস্তবায়নাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ‘করিডর সিলেকশন ভুল ছিল’-এমন মূল্যায়নে পৌঁছেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা। আর এ ভুলের জন্য গচ্চা দিতে হচ্ছে ৩ হাজার কোটি টাকা। যা ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের যে কোনো বিআরটি প্রকল্পের চেয়ে ছয় গুণ বেশি সময় নিয়ে এবং চার গুণ অতিরিক্ত খরচ করেও অদ্যাবধি শেষ হয়নি কাজ। এমন অবস্থায় এ প্রকল্প বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন এটি বিশেষায়িত বাস লেনের পরিবর্তে সাধারণ চার লেন সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ ব্যাপারে সামগ্রিক মূল্যায়নের জন্য একটি কারিগরি কমিটি করা হচ্ছে। একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞকে প্রধান করে শিগগিরই এ কমিটি গঠন-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
সড়ক পরিবহন, সেতু এবং রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনউদ্দিন জানান, অন্তর্বর্তী সরকার গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি প্রকল্প নিয়ে আর এগোবে না। এটি সাধারণ চার লেনের সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হবে। বিআরটি প্রকল্প নিয়ে নানা কথা রয়েছে। সেসব মূল্যায়ন করে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের অর্থ থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আর কোনো টাকা এ প্রকল্পে খরচ করবে না। প্রকল্পটি এখানেই শেষ করে দেওয়া হবে।