ব্র্যাক ব্যাংকের ‘আস্থা অ্যাপ’ ব্যবহার করছেন ১০ লাখের বেশি গ্রাহক। দিনদিন অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাংকটির। অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি তারেক রেফাত উল্লাহ খান।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের সব ব্যাংক এখন অ্যাপ লেনদেনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এতে কতটা সুফল মিলেছে?
তারেক রেফাত উল্লাহ খান : প্রথমত, অ্যাক্সেসিবিলিটি বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাহক এখন যে কোনো সময় এবং যে কোনো স্থান থেকে লেনদেন করতে পারছেন, যা ব্যাংকিং সেবা আরও সহজ এবং সুবিধাজনক করে তুলেছে। ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে এখন গ্রাহকের হাতের নাগালে।
দ্বিতীয়ত লেনদেনের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে গ্রাহকের সময় সাশ্রয় হচ্ছে এবং ব্যাংকিং কার্যক্রমেও দক্ষতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জাতীয় অর্থনীতির ডিজিটালাইজেশনও এগিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত নিরাপত্তা উন্নত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সাইবার সিকিউরিটিব্যবস্থা গ্রাহকের তথ্য এবং অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর গ্রাহক আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংকিং অ্যাপ ক্যাশলেস লেনদেন কালচার প্রসার করছে। আমরা জানি, নগদ লেনদেনের মাধ্যমে অনেক সময় অনিয়ম ও অবৈধ কাজ হয়ে থাকে। অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল লেনদেন হলে অনেক অনৈতিক ও অবৈধ কাজ বন্ধ হবে। চতুর্থত ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক তাদের অ্যাপের মাধ্যমে নতুন সেবা এবং অফার দিচ্ছে, যা গ্রাহকের জন্য আরও বেশি সুবিধা নিয়ে এসেছে। সুষম প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গ্রাহকসেবার মান উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
পঞ্চমত ব্যাংকিং খাতের প্রসার ঘটেছে। ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যেসব স্থানে তাদের ব্রাঞ্চ নেই, সেসব এলাকার গ্রাহকের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংকগুলো অ্যাপভিত্তিক লেনদেনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করায় গ্রাহকের জন্য সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যাংকিং সেক্টরেরও উন্নয়ন ঘটেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : মানুষ সেলফ সার্ভিস ব্যাংকিংসেবায় আগ্রহী হয়ে উঠছে; ঘরে বসেই ব্যাংকিং করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। অ্যাপ লেনদেন তারই প্রমাণ। এ সেবার ভবিষ্যৎ কী?
সেলফ সার্ভিস বা স্বয়ংক্রিয় ব্যাংকিংসেবায় মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠার ফলে ব্যাংকিং খাতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ঘরে বসেই ব্যাংকিং করার সুবিধা নতুন গ্রাহক অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে। পাশাপাশি এটি গ্রাহকের জীবনযাত্রা সহজতর করেছে। অ্যাপভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমে এ পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হয়েছে। সেলফ সার্ভিস ব্যাংকিংসেবার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং এটিই এখন ব্যাংকিংয়ের মূলধারা। এটি শুধু একটি ট্রেন্ড নয়, স্থায়ী রূপান্তরও। এর কিছু কারণ রয়েছে।
এআই ও পারসোনালাইজেশন : ভবিষ্যতে অ্যাপগুলো হবে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। অ্যাপই গ্রাহকের ব্যয়ের ধরনের ভিত্তিতে প্রাসঙ্গিক অফার, বাজেট পরামর্শ বা সঞ্চয়ের পরিকল্পনা সুপারিশ করবে। ব্যাংকিংসেবা হবে অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, যা গ্রাহক অভিজ্ঞতা নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
ফাইন্যান্সিয়াল প্ল্যাটফর্ম : ব্যাংকিং অ্যাপ শুধু টাকা পাঠানো বা বিল পরিশোধের জায়গায় থাকবে না। এটি একটি ইন্টিগ্রেটেড লাইফস্টাইল প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে, যেখান থেকে গ্রাহক ব্যাংকিংসেবার পাশাপাশি বিমা, মার্চেন্ট পেমেন্ট, বিনিয়োগ ও সরকারি সেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো নিতে পারবেন।
ওপেন ব্যাংকিং : ভবিষ্যতে বিভিন্ন ফিনটেক কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারি বাড়বে। এখানে ডেটা শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ থেকেও উদ্ভাবনী আর্থিক সেবা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অ্যাপ লেনদেনে কী কী ঝুঁকি আছে? নিরাপত্তা নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রাহক কতটা সচেতন?
তারেক রেফাত উল্লাহ খান : অ্যাপ লেনদেনে কিছু ঝুঁকি বিদ্যমান, যা গ্রাহকের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। সাইবার আক্রমণ, যেমন হ্যাকিং এবং ফিশিং গ্রাহকের তথ্য চুরির আশঙ্কা তৈরি করে। এ ছাড়া ডেটা সুরক্ষা যথাযথভাবে না হলে ব্যক্তিগত এবং আর্থিক তথ্য বিপদে পড়তে পারে। প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা অ্যাপের মধ্যে সমস্যা লেনদেনের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা গ্রাহকের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে। ভুল তথ্য প্রবেশের কারণে গ্রাহক ভুল লেনদেন করতে পারেন, যা তাঁদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ব্র্যাক ব্যাংক গ্রাহক নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। আমাদের গ্রাহকও তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন। আমরা নিয়মিতভাবে গ্রাহকের জন্য নিরাপত্তা সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করি। এর মধ্যে রয়েছে সেমিনার, কাস্টমার মিট, ইমেইল, এসএমএস নির্দেশিকা ইত্যাদি। আমরা গ্রাহকের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন, বায়োমেট্রিক লগইন, অ্যাডভান্সড এনক্রিপশন, ২৪/৭ ফ্রড মনিটরিং সিস্টেমের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অ্যাপের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
তারেক রেফাত উল্লাহ খান : অ্যাপের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি আর্থিক খাতে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ভবিষ্যতে এটি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হচ্ছে। ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নতি, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং গ্রাহক অভিজ্ঞতা উন্নত হওয়ার কারণে দৈনিক অ্যাপভিত্তিক লেনদেনের পরিমাণ নিয়মিতই বাড়ছে।
এটি ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। ব্যাংকগুলোর উন্নত ব্যাংকিং অ্যাপ, এমএফএসের বিস্তার, সর্বোপরি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সহজলভ্যতা গ্রাহককে অ্যাপভিত্তিক লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করবে, যার ফলে লেনদেনের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। ফলে আমরা একটি ‘ক্যাশলেস’ অথবা ‘লেসক্যাশ’ সোসাইটিতে পরিণত হব। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে অনেক ব্যাংক খুবই ভালো করবে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকবান্ধব পেমেন্ট সল্যুশন নিয়ে আসবে। গতানুগতিক ব্যাংকিংব্যবস্থায় আসবে বড় পরিবর্তন।
এভাবে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছে পেমেন্ট সল্যুশন প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে, যা ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। ক্রসবর্ডার লেনদেন, উন্নত পেমেন্ট সিস্টেম ও সাশ্রয়ী হওয়ায় ডিজিটাল লেনদেনের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে বৃদ্ধি পাবে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিকাশে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এসব কারণে অ্যাপের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সক্ষমতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহক কী কী সেবা গ্রহণ করছেন?
তারেক রেফাত উল্লাহ খান : ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপগুলো এখন শুধু টাকা পাঠানোর চ্যানেলই নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক সেবাদানকারী প্ল্যাটফর্মও।
ব্র্যাক ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ ‘আস্থা’ ব্যবহার করে গ্রাহক বিভিন্ন ব্যাংকিংসেবা নিতে পারছেন, যা তাঁদের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা সহজ এবং সুবিধাজনক করে তুলেছে। গ্রাহক আমাদের অ্যাপ ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংকিং লেনদেন যেমন টাকা পাঠানো, ইউটিলিটি ও ক্রেডিট কার্ড বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম পরিশোধসহ আরও অনেক সেবা মুহূর্তেই নিতে পারছেন। অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহক এফডিআর, ডিপিএস খোলাসহ ঋণের আবেদন করতে পারছেন। অ্যাকাউন্ট খোলা, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও ট্যাক্স সার্টিফিকেট ডাউনলোড সুবিধা গ্রাহককে দিচ্ছে বাড়তি সুবিধা। এ ছাড়া এ অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন মার্চেন্ট পয়েন্ট ও ওয়েবসাইটে কিউআর পেমেন্ট করা যায়, যা গ্রাহকের জন্য অত্যন্ত সহজ ও সুবিধাজনক। অতি সম্প্রতি আস্থা অ্যাপের মাধ্যমে ইন্স্যুরেন্স সেবা ও শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের বিও অ্যাকাউন্ট খোলা যাচ্ছে। আমরা নিয়মিতভাবেই আস্থা অ্যাপে নতুন নতুন সার্ভিস যুক্ত করছি। গ্রাহক এখন আগের চেয়ে আরও বেশি সময়সচেতন। অ্যাপের মাধ্যমে ব্যাংকিংসেবা তাঁদের জন্য সময় ও অর্থ দুটিই সাশ্রয় করে। তাই গ্রাহক ডিজিটাল মাধ্যমে ঝুঁকছেন। গ্রাহকের এ আগ্রহ ও নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে বর্তমানে আস্থা অ্যাপে গ্রাহক পাচ্ছেন দৈনন্দিন জীবনের সব সমাধান।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অ্যাপভিত্তিক লেনদেন নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
তারেক রেফাত উল্লাহ খান : অ্যাপভিত্তিক লেনদেন নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ কৌশলগত পরিকল্পনা আমরা তিনটি স্তরে সাজিয়েছি : ডেটা-ড্রিভেন পারসোনালাইজড ব্যাংকিং : আমাদের পরিকল্পনা হলো, গ্রাহকের লেনদেনের ধরন, প্রকৃতি ও পছন্দ বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁদের ব্যাংকিংসেবা অফার করা। ইন্টিগ্রেটেড ফাইন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম গঠন : আমরা আমাদের অ্যাপকে একটি পূর্ণাঙ্গ ফাইন্যান্সিয়াল হাবে রূপান্তরে কাজ করছি, যেখানে গ্রাহক শুধু ব্যাংকিং সেবাই নয়, বরং সব আর্থিক প্রয়োজন, যেমন বিনিয়োগ, বিমা, মার্চেন্ট পেমেন্ট থেকে শুরু করে লাইফস্টাইল সেবা পর্যন্ত সবকিছুই পাবেন। গ্রাহক ঘরে বসেই ঝামেলাহীনভাবে সব সেবা এক প্ল্যাটফর্ম থেকে উপভোগ করতে পারবেন। আমাদের লক্ষ্য ইন্টারঅপারেবেলিটি বাড়ানো এবং গ্রাহকের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা।
গ্রাহক ক্ষমতায়ন : আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে গ্রাহকদের ক্ষমতায়ন করা। গ্রাহকের জন্য এক প্ল্যাটফর্মে ফাইন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম নিশ্চিত করা গেলে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী মুহূর্তেই যে কোনো ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন। এতে গ্রাহক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হবে আরও ত্বরান্বিত।