ঋণের বোঝা সামলাতে না পেরে ঋণগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যা করার ঘটনা দিনদিন বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে আত্মহত্যা করছেন। কেউ আবার তার পরিবারকে হয়রানির হাত থেকে রক্ষার জন্য হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছেন। সামাজিক কটূক্তির ভয়ে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যার মতো অপরাধে জড়াচ্ছেন।
সম্প্রতি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারসহ আত্মহত্যা করার ঘটনাগুলো সামনে আসার কারণ হচ্ছে, একজনকে পরিবারসহ আত্মহত্যা করতে দেখে অন্য যারা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন, তারাও একই রাস্তা অনুসরণ করছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবার খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষই এজন্য বেশি ঋণ করছে। এ ঋণের বড় অংশই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে নিচ্ছে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্রঋণ অনেকের কাছেই আশার আলো। আবার কিছু ক্ষেত্রে তা কারও জন্য গলার ফাঁস হয়ে ওঠে। চড়া সুদ ও কিস্তির কঠোর চাপে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে। দেশের ৭০ শতাংশ পরিবার গ্রামে থাকে। তাদের বড় একটা অংশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে জড়িত। অনেকেই ঋণ শোধ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পৈতৃক জমিজমা বা সম্পদ বিক্রি করেন। ঋণের কিস্তি সময়মতো দিতে না পারলে হতে হয় হয়রানির শিকার। সামাজিকভাবে অপদস্থ হয়ে অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেন। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনা সামনে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অতনু রব্বানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঋণগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি ঋণের চাপে যদি আত্মহত্যা করেন তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কাউকে ঋণ দেওয়ার সময় অবশ্যই যাচাইবাছাই করে দেওয়া উচিত।’
‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’ এমন চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেন রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামের মিনারুল ইসলাম (৩৫)। আত্মহত্যার আগে তিনি হত্যা করেন তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে। ১৫ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মিনারুল কৃষিকাজ করতেন। চিরকুটে মিনারুল আরও লেখেন, ‘এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম। সেই ভালো হলো। কারও কাছে কিছু চাইতে হবে না।’ পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় এনজিও ও স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন এক ব্যবসায়ী। নান্না ফরাজী (৫৫) নামের এ ব্যবসায়ী উপজেলার মিরুখালী ইউনিয়নের বাদুরা গ্রামে সুপারির ব্যবসা করতেন। ২৭ আগস্ট কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর আগে নান্নাও চিরকুটে লিখে যান ‘আমি মেলা টাকা দেনা। দেওয়ার মতন কোনো পথ নাই। দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই।’
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার খাড়ইল গ্রামে ১১টি এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া এক কৃষকও আত্মহত্যা করেন। আকবর হোসেন (৫০) নামে ওই কৃষক ১১টি এনজিও ও স্থানীয় সুদ কারবারিদের কাছ থেকে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছিলেন না। ১৮ আগস্ট নিজের পানবরজে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। আকবর হোসেনের ছেলে সুজন জানান, ঋণের কিস্তি ছিল প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা। পানের দাম না পেয়ে আকবর ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। কিস্তির জন্য প্রতিদিন এনজিওর লোকেরা চাপ দিতেন।
আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় উৎপাদনশীল কোনো কাজের জন্য নয়, ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য বা আগের ঋণ পরিশোধের জন্যই মানুষ ঋণ করে। গ্রামাঞ্চলে একজন পাঁচ থেকে সাতটি এনজিও বা ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ করেন। গ্রামে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নেওয়ার হার বেড়েছে। এত বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে একজন ব্যক্তিকে সামাজিক কটূক্তির শিকার হতে হয়। সুদ গ্রহণ করার কারণে সামাজিকভাবে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আবার নতুন করে কেউ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে টাকাও ধার দেন না। এ সংকটগুলোর কারণে সেই ব্যক্তি আত্মহত্যার চিন্তা করেন। এ সময় পরিবারের দুশ্চিন্তা তার মধ্যে কাজ করে। তখন তিনি পরিবারসহ আত্মহত্যা করেন।’