গত ২৮ আগস্ট গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরের ওপর নৃশংস হামলা কি কোনো ষড়যন্ত্রের আলামত? জাতীয় পার্টির এক নেতা ভারত সফর করে আসার পর এ ঘটনা নিঃসন্দেহে জনমনে নানা প্রশ্ন জাগাচ্ছে। এরপরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাদের চক্রান্তে নিকটবর্তী গ্রামবাসীকে উসকে দিয়ে ভয়ানক হামলা চালানো হলো সাধারণ শান্তিপ্রিয় ছাত্রদের ওপর। একটা বিষয় রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলে চাউর হচ্ছে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় ওই দলের নেতারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বসে বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন ভন্ডুল অথবা জাতীয় পার্টির প্রার্থী ‘ছদ্মবেশে’ বেশ কিছু সংসদীয় আসন দখলে নেওয়ার অপচেষ্টায় শক্তপোক্ত ষড়যন্ত্রের জাল ফেলেছে। পতিত রাজনৈতিক দলটি এ দেশে একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং গণমানুষের প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করবে সেটা সহজেই অনুমেয়। এ দলটি প্রতিশোধপরায়ণতার প্রমাণ অতীতেও বহুবার দিয়েছে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ক্ষমতাদর্পী রাজনীতির চেহারাটা আমরা স্মরণ করতে পারি। সেই দলটির সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও মেধাবী নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বদানকারী এই নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে ‘প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে’ মন্ত্রিসভা থেকে বের করে দেওয়া হয়। ক্ষমতাধর দলটির প্রধান নেতার সেই সিদ্ধান্তটি ছিল আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী চেহারার প্রথম বহিঃপ্রকাশ। যাঁকে বের করে দেওয়া হলো তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা দলবিরোধী অথবা রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের সামান্যতম অভিযোগও প্রমাণ করা যায়নি। বরং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে সুসংগঠিত যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। অথচ তাঁর প্রতি নিদারুণ অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হয়। ১৯৭৪ সালে পদত্যাগে বাধ্য করা হলো একজন সফল অর্থমন্ত্রীকে। আওয়ামী লীগ দলটি যে ঈর্ষাকাতর, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং অকৃতজ্ঞ তার প্রমাণ দিয়েছে বারবার। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোটে যোগদান সমর্থন না করে যখন নতুন দল (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা করলেন তখন বিনা প্ররোচনায় সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা ইটপাটকেল ছুড়ত, হামলা করে সমাবেশ পণ্ড করার অপচেষ্টা চালাত। সেই দলটির কাছে কতটা যৌক্তিক, শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আশা করা যায়!
সাড়ে পনেরো বছরের বেশি সময় চরম ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শাসন চালানোর পর রাজপথে হাজারের বেশি গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ১৩ হাজার রাজপথের কর্মীকে গুলিবিদ্ধ, গুরুতর আহত ও পঙ্গু বানিয়ে, শেষাবধি চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে দেশত্যাগ। গুম-খুন, গণহত্যা, জেলজুলুম, অত্যাচার করেও তারা এ দেশের মাটিতে টিকে থাকতে পারেনি। রাজপথের নির্যাতিত কর্মীদের আক্রোশে প্রায় পদপিষ্ট হওয়ার দশায় দলের প্রধানসহ প্রায় সব নেতা পালিয়ে বাঁচেন ৫ আগস্ট।
এরই মধ্যে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ে রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের দায়ী ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বিচার শুরু করেছে। তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতারা নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অবশ্যই প্রত্যাশিত এবং তাতে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে আর সরকার গঠনেও সক্ষম হবে বলে দেশবাসীর বিশ্বাস।
জনগণই দেশের মালিক-মোক্তার। তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি তথাকথিত ইসলামি দল ও তাদের চ্যালাচামুণ্ডারা এক হয়েছে। তারা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নামে উদ্ভট এক ব্যবস্থা কায়েমের তৎপরতায় মরিয়া। সবারই জানা, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন করা গেলে এই মতলববাজরা ১০০ থেকে ১১০টি আসন সহজেই পেয়ে যেতে পারে। আর যদি সাধারণভাবে ‘ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্র’ পদ্ধতির সাধারণ নির্বাচন হয় তাহলে এসব ধর্মভিত্তিক ও বাম দলের সর্বসাকল্যে ৩৫টি আসনের বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এসব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটির বিরুদ্ধে ভয়ানক ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তারা নির্বাচন আরও পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। তারা জানে, বর্তমান পদ্ধতির নির্বাচন সুষ্ঠু কায়দায় সম্পন্ন হলে তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারেই থাকবে না। তাই নির্বাচন যত দেরিতে হয় তাদের জন্য বাড়তি অর্জনের সম্ভাবনা বাড়তেই থাকবে। আর যদি পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের আন্দোলনটি বেগবান করা যায়, এ সময়টাতে তাতে তাদের উভয় দিক থেকেই বাড়তি লাভ।
এখন আমাদের ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখা দরকার, নির্বাচন যত পেছাতে থাকবে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের মাফিয়া রাজনীতিকরা এ দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ তত বেশি পাবে। ষড়যন্ত্রে পারদর্শিতার ক্ষেত্রে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের মতো আর কেউ নেই এ দেশে। আরেকটা ব্যাপার, আমাদের ইসলামপন্থি ও বাম দলগুলোকে ভাবতে হবে যে আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকারের পতন ঘটেছে তার অর্ধেক অবদান বিএনপির সাড়ে পনেরো বছরের আন্দোলনের, বাকি অর্ধেক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের, অতিসামান্য অবদান ধর্মভিত্তিক দলগুলো ও বাম রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলোর। যদি প্রচণ্ড অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে বিএনপি ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম চালু না রাখত তাহলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এত দ্রুত এতটা শক্তি অর্জনে সক্ষম হতেন না। এখন ফ্যাসিবাদীদের পতনের আন্দোলনের একক কৃতিত্ব দাবি করে কেউ কেউ অতিমাত্রায় অহংকারী হয়ে উঠেছেন, এটা নিতান্তই অনৈতিক। তারা দয়া করে বিএনপির ১৬ বছরের আন্দোলন-লড়াইয়ের ইতিহাসটা ভালোভাবে অধ্যয়ন করলে নিজেরাই লজ্জা পাবেন।
বিএনপি যদি এ আন্দোলন তুঙ্গে নিতে না পারত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা সামনে এগোনোর শক্তি অর্জন করতে পারতেন না। ফলে কী পরিণতি হতো এ দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের? শেখ হাসিনার অপসারণ না ঘটলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ সেলিম, শেখ তাপস, শেখ পরশ, শেখ হেলাল, হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পুত্র এসব শেখ গোষ্ঠী আরও ২৫ বছর ক্ষমতা দখল করে থাকত। তারা ফ্যাসিবাদের চরম পর্যায়ে পৌঁছে দেশকে একদলীয় ‘বাকশাল’ সিস্টেমের পথে নিয়ে যেত। ইতোমধ্যে বিরোধী সব দলের নেতা-কর্মীর ওপর পাইকারি হত্যাকাণ্ড চালাত। আরেকটা বড় অংশকে কারাবন্দি করত। এতে মদত দিত প্রতিবেশী ভারত। চীন, জাপান, আমেরিকা বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের ব্যবসাবাণিজ্য সমরাস্ত্র বিক্রির স্বার্থে সমর্থন দিত এই শেখ গোষ্ঠীকে। তার বড় প্রমাণ স্বৈরাচার এরশাদ। তাঁর ৯ বছরের শাসনকালে অন্তত ৬ লাখ কোটি টাকার (বর্তমান মুদ্রা মানে) রাষ্ট্রসম্পদ লুট হয়েছে, অসংখ্য গুম-খুন, রাজপথে বিরোধী দলের কর্মী হত্যা চলেছে, ভয়ংকর জেলজুলুম, স্বৈরাচারবিরোধীদের নিঃশেষিত করেছে। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এসবে বাধা দিলে এরশাদ অবৈধ ক্ষমতা দখল করে দুই বছরও টিকতে পারত না। এবার শেখ পরিবার ২৫ বছর স্বৈরশাসন চালালেও ওই সব বন্ধুরাষ্ট্র সবকিছু মেনে নিত।
সেরকম একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে দেশবাসী যে বেঁচে গেছে তার জন্য জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেতা-কর্মী ও তার পূর্ববর্তী ১৬ বছরের আন্দোলনের রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আমাদের সবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এখন আমাদের দরকার ইস্পাতকঠিন ঐক্য। সব রাজনৈতিক দলের উচিত দ্রুততম সময়ে ওয়েস্টমিনস্টার সিস্টেমের গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে জানবাজি লড়াই করা। এরপরে প্রয়োজন পড়লে অন্য অনেক রাজনৈতিক সংস্কারের কথা ভাবা যাবে। সে লক্ষ্যেই তো নতুন সংসদ কাজ করবে এবং এ ব্যাপারে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দল অঙ্গীকারবদ্ধ। আসুন সেই লক্ষ্যে একটু আত্মত্যাগী হই, দলের চেয়ে রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রবাসীকে ঊর্ধ্বে নিয়ে চিন্তাভাবনা করি।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক