এক দেশে দুইটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করেছে। একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেটাকে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক নামে চিনি, আরেকটা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে চালানো হতো। ১২-১৪টি ব্যাংকের সব সেখান থেকে ঘটত। আর বাংলাদেশে লুট হওয়া ব্যাংকের সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে ৭টি সরাসরি ও বাকিগুলো লুট হয়েছে পরোক্ষভাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে ‘ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক এক আলোচনায় সভায় রবিবার এসব কথা বলেন ব্যাংকার ও আলোচকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ-ওয়েইডেন যৌথভাবে দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করা হয় গত শনিবার। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনা সভা হয়।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম। ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বক্তব্য দেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন, সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। এ ছাড়া সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মূল প্রবন্ধে মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, আর্থিক খাত সংস্কার একটি জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। দেশে যেমন কয়েকটি ভালো ব্যাংক আছে, তেমন কিছু ‘জম্বি ব্যাংকও’ আছে। আবার কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মোট বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশের ওপরে। দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর স্বাধীনতা দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, জম্বি ব্যাংক হচ্ছে সে ধরনের ব্যাংক, যেসব ব্যাংক মূলত দেউলিয়ার পর্যায়ে রয়েছে। তবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যাদের আমানত পরিশোধের সক্ষমতাও নেই।
মূল প্রবন্ধে মাহমুদ ওসমান ইমাম আরও বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এমন বিধান করতে হবে, যাতে এক পরিবারের সর্বোচ্চ দুজন সদস্য ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন। পরিচালকদের মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছরে নামিয়ে আনা দরকার। সেই সঙ্গে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে মালিকপক্ষের বাইরের কারও থাকার বিধান করা দরকার।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে ৪ লাখ কোটি টাকা মন্দ ঋণ, আর ৭ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ (ডিট্রেসড) অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। বিদেশি ব্যাংক বাদ দিয়ে স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে প্রায় ৫০টি। এর মধ্যে ১০টি ব্যাংক কমবেশি বিশ্বমানের বা আঞ্চলিক মানের। প্রায় ১৫টি ব্যাংককে বলা হচ্ছে লুট হওয়া ব্যাংক। ৭টি ব্যাংক সরাসরি লুট হয়েছে, আর বাকি ৬-৭ ব্যাংক পরোক্ষ লুট হয়েছে। সরকার এই ১৪-১৫টি ব্যাংকের মধ্যে ৫টিকে একীভূত করছে। এই ৫টি 'জম্বি ব্যাংক'। আর বাকি যে ২৪-২৫টি ব্যাংক থাকে, তারা আসলে ভালো ব্যাংক।
তিনি আরও বলেন, আমরা বাংলাদেশে দুইটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছি। একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেটাকে বাংলাদেশ ব্যাংক নামে চিনি, আরেকটা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে চালানো হতো। ১২-১৪টি ব্যাংকের সব সেখান থেকে ঘটত। এটা দুঃখজনক। এক এস আলম বেনামে পুরো ব্যাংক খাত ধ্বংস করেছেন।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। গত মার্চে তা বেড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০২৫ সালের জুনের হিসাবে খেলাপি ঋণ আরও দেড় লাখ কোটি টাকা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে। ফলে অনেক আমানতকারী প্রয়োজনের সময় টাকা তুলতে পারছেন না, যা ব্যাংক খাতের জন্য বড় সংকট।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বলেন, ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘হুইসেলব্লোয়িং’ নীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা। আগামী নির্বাচনের পর যে সরকার আসুক না কেন, তাদের উচিত এই খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ