আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা হেকমত বা জ্ঞান দান করেন; আর যাকে হেকমত দান করা হয়েছে, তাকে সত্যিই অফুরন্ত কল্যাণ দান করা হয়েছে।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ২৬৯।) এই আয়াত জ্ঞানের গুরুত্ব এবং এর বাহকদের মহিমাকে তুলে ধরে। শিক্ষা এমন এক আলো, যা মানুষের হৃদয় ও মনকে আলোকিত করে, সংকীর্ণতা দূর করে এবং সঠিক পথের দিশা দেখায়। আর এই আলোর প্রধান বাহক হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশার নাম নয়, এটি এক মহান আমানত, এক বিশাল দায়িত্ব এবং সমাজের স্তম্ভস্বরূপ। ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’- এই কথাটি কেবল একটি প্রবাদ নয়, বরং এটি একটি অকাট্য বাস্তবতা। একটি জাতি কতটা উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে, তা নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের ভূমিকা ও মানের ওপর। একজন আদর্শ শিক্ষক হলেন সেই কারিগর, যিনি একটি জাতিকে আদর্শ মানুষে পরিণত করেন, যারা ভবিষ্যতে দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করে। যেমনভাবে একজন স্থপতি একটি ইমারত নির্মাণ করেন, তেমনি একজন শিক্ষক গড়েন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নের দিকদর্শন।
ইসলামে শিক্ষকের মর্যাদা অত্যন্ত সুমহান। স্বয়ং রসুলুল্লাহ (সা.) নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম শরিফ, ১৪৭৮।) এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি নবুয়তের এক পবিত্র অংশ। যিনি শিক্ষা দেন, তিনি নবীগণের দায়িত্বের ধারক ও বাহক। ইসলাম জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করেছে, তা পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম বা জীবনদর্শনে বিরল। একজন শিক্ষক মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোতে নিয়ে আসেন, আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়তা করেন। এ কারণেই শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়টি ইসলামি সংস্কৃতিতে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। শিক্ষককে বলা হয় সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা। সত্যিই তো, জন্মদাতা পিতা শুধু জন্ম দিয়ে থাকেন, কিন্তু তাকে সত্যিকার একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক। তিনি শুধু জ্ঞান দান করেন না, বরং নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সুন্দর জীবনযাপনের পদ্ধতিও শেখান। তাই ইসলামি মনীষীরা শিক্ষককে ‘রুহানি পিতা’ বা আত্মিক পিতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতো মহান ব্যক্তিত্ব তাঁর ওস্তাদের প্রতি এতটাই সম্মান প্রদর্শন করতেন যে তিনি ওস্তাদের বাড়ির দিকে পা মেলে বসতেন না, যদি এতে শিক্ষকের প্রতি অসম্মান হয়! এই ঘটনা শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং যারা জ্ঞান অর্জন করেছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা অনেক উচ্চ করে দেবেন।’ (সুরা আল-মুজাদালা, আয়াত ১১) এ আয়াত জ্ঞান অর্জনকারী এবং জ্ঞান দানকারী উভয়ের মর্যাদা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়। হাদিস শরিফে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমান ও জমিনের সমস্ত সৃষ্টি, এমনকি পিঁপড়াও তার গর্তে এবং মাছ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে, যে মানুষকে কল্যাণকর জ্ঞান শেখায়।’ (তিরমিজি শরিফ, ২৬৮৫।) এ হাদিস প্রমাণ করে, একজন শিক্ষক কেবল পার্থিব সম্মানই নয়, বরং আল্লাহতায়ালা ও তাঁর সৃষ্টির পক্ষ থেকে বিশেষ আশীর্বাদ ও দোয়ার অধিকারী।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের সমাজে সেই শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান হারাতে বসেছে। যেখানে হাদিস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, একজন শিক্ষক আসলে কত সম্মানের অধিকারী, সেখানে আজ আমাদের দেশে সামান্য কারণে-অকারণে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হয়, মারধর করা হয়, এমনকি পুকুরে ফেলে দেওয়ার মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়, প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। অথচ এই শিক্ষকরাই আগামী দিনের নেতা, বিজ্ঞানী, বিচারপতি, ডাক্তার ও আলেমদের গড়ে তোলেন। একসময় শিক্ষকতা ছিল ‘জ্ঞানভিত্তিক সেবার পেশা’, যেখানে মেধা ও নৈতিকতার সমন্বয় ঘটত। আজ তা অনেক ক্ষেত্রে অবহেলার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় শিক্ষকদের সীমাহীন মর্যাদা দেওয়া হয়। কারণ তারা জানে যে শিক্ষককে সম্মান না দিলে জাতি অন্ধকারেই থেকে যায়। শিক্ষাকে পবিত্র পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে, আমাদের প্রথম কাজ হবে শিক্ষককে তার যোগ্য মর্যাদায় ফিরিয়ে দেওয়া। শুধু নীতি কথা বা কাগজকলমে নয়, বাস্তবে গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে এবং শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকতাকে নিরাপদ ও সম্মানিত পেশায় পরিণত করতে হবে, যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতাকে তাদের প্রথম পছন্দের পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী হয়।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল চরপাথালিয়া সালমান ফারসি রা. মাদরাসা, মুন্সিগঞ্জ