ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর গাজা দখলের নতুন সামরিক পরিকল্পনা ঘিরে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সতর্কতা ও ক্ষোভের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বেগ জানিয়েছে।
১০ ঘণ্টাব্যাপী নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে গাজা শহর দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একে যুদ্ধের নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে মনে করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপ কার্যত গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের লক্ষ্যে গৃহীত হলেও নেতানিয়াহুর দপ্তরের বিবৃতিতে অধিকারে শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এয়াল জামির স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, গাজার পূর্ণ দখল একটি ফাঁদের মধ্যে পা দেওয়ার সমান এবং এটি জীবিত জিম্মিদের জন্য চরম বিপজ্জনক হতে পারে। ইসরায়েলি মিডিয়া মারিভ জানিয়েছে, বিস্তৃত অভিযানের সময় অধিকাংশ মানে সম্ভবত সব জীবিত জিম্মিই নিহত হতে পারেন।
জিম্মিদের পরিবারের বহু সদস্য যুদ্ধ বন্ধ করে হামাসের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে জিম্মি মুক্তির দাবিতে সোচ্চার। জরিপ অনুযায়ী, বেশির ভাগ ইসরায়েলি নাগরিক একটি চুক্তির মাধ্যমে ৫০ জন জিম্মির মুক্তি চান, যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেতানিয়াহুর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার এই পদক্ষেপ অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন। তার জোট সরকারে উগ্র জাতীয়তাবাদী মন্ত্রীরা (যেমন- ইতামার বেন গভির ও বেজালেল স্মোটরিচ) যুদ্ধ থেমে গেলে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন। তারা প্রকাশ্যে গাজার ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছামূলক স্থানান্তরের পক্ষে মত দিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার। তিনি এই সিদ্ধান্তকে ভুল বলে আখ্যা দিয়ে ইসরায়েলকে তা অবিলম্বে পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও নেতানিয়াহুর অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনও প্রকাশ্যে এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেনি।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েল গাজার সম্পূর্ণ নিয?ন্ত্রণ নিতে চায়। তবে সেখানে শাসক হিসেবে থাকতে চায় না। তিনি বলেন, আমরা তা আরব শক্তির হাতে তুলে দিতে চাই। যদিও কোন দেশ বা বাহিনী জড়িত থাকবে, সে বিষয়ে কিছুই স্পষ্ট করেননি নেতানিয়াহু।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। -বিবিসি
নতুন এই দখল পরিকল্পনা গাজা সংকটকে আরও জটিল ও রক্তক্ষয়ী করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। যুদ্ধ থামানো না গেলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবিক বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা; এই তিনটি চাপে ইসরায়েল পড়তে যাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
গাজা দখলের পরিকল্পনা অবিলম্বে বাদ দিন
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় পূর্ণ সামরিক দখলদারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা থেকে অবিলম্বে সরে আসতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক।
গতকাল ফলকার টুর্ক সতর্ক করে বলেন, এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবে এবং আরও ব্যাপক ভোগান্তির জন্ম দেবে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের জারি করা এক বিবৃতিতে টুর্ক বলেন, এ পরিকল্পনা ‘আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) সেই রায়ের পরিপন্থি; যেখানে বলা হয়েছে ইসরায়েলকে যত দ্রুত সম্ভব দখলদারির অবসান ঘটাতে হবে।’
মানবাধিকারপ্রধান আরও বলেন, এ পদক্ষেপ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ও ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারেরও পরিপন্থি।
টুর্ক বলেন, ‘এ পর্যন্ত পাওয়া সব প্রমাণ বলছে, এ নতুন উত্তেজনা আরও ব্যাপকভাবে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, আরও হত্যাযজ্ঞ, অসহনীয় কষ্ট, অযৌক্তিক ধ্বংসযজ্ঞ ও যুদ্ধাপরাধ ডেকে আনবে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, গাজায় যুদ্ধ এখনই শেষ হতে হবে এবং ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের ‘শান্তিতে পাশাপাশি বসবাসের সুযোগ দিতে হবে।