দেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের ভিতর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এক বৈশিষ্ট্যময় মিশ্র চিরহরিৎ বর্ষারণ্য। মৌলভীবাজার রেঞ্জের ২ হাজার ৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইনে ১৯৯৬ সালে সরকার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। পরিচিতির দিক দিয়ে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার অবস্থান। এ বনে রয়েছে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২২ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে ৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড, ২ প্রজাতির কচ্ছপ ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি। আয়তনে ছোট হলেও এ বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং বন্যপ্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রায় প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বনের প্রাণী। খালি হচ্ছে সংগ্রহশালা। লাউয়াছড়া বনের বুক চিড়ে যাওয়া শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ ৮ কিলোমিটার সড়ক ও আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের ৫ কিলোমিটার রেলপথ প্রাণীদের মৃত্যুর কারণ। রেল ও সড়কপথ পারাপার হতে গিয়ে গত ১০ বছরে সহস্রাধিক প্রাণী মারা গেছে। মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে লোপার্ড ক্যাট, গন্ধগোকুল, বিরল প্রাণী লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান, মায়াহরিণ, লিজার্ড, শজারু, অজগর, ভাইপার। এ ছাড়া মৃত্যু তালিকায় রয়েছে বানর, সঙ্খিনি, দাঁড়াশ ও সবুজ ডোরা সাপ, শিয়াল ও বন্য শূকরের মতো বিরল, বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। এই মৃত্যু রোধে কর্তৃপক্ষের যে কোনো উদ্যোগ ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে এসবই ছিল লোক দেখানো। না হলে এগুলো বাস্তবায়ন হলো না কেন-এ প্রশ্ন থেকেই যায়। বন্যপ্রাণীদের মৃত্যু রোধে ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বিকল্প সড়ক উন্নয়নের কাজ আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
২০২২ সালে স্থানীয় বন বিভাগের নেওয়া লাউয়াছড়ার ভিতর সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালানোর উদ্যোগও ভেস্তে যায়। চালকরা মানছেন না সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে ২০ কিলো গতিতে গাড়ি চালানোর রোডসাইন।
একইভাবে রেললাইনে কাটা পড়ে বন্যপ্রাণীর মৃত্যু রোধে এবং প্রাণীদের জীবনযাত্রা নির্বিঘœœ করতে ২০২৩ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নেওয়া লাউয়াছড়ার ভিতর ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর উদ্যোগও বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া রেললাইনে কাটা পড়ে বন্যপ্রাণীর মৃত্যু রোধ এবং প্রাণীদের জীবনযাত্রা নির্বিঘœœ করতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে লাউয়াছড়ার ভিতর ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রেলওয়ের মহাপরিচালককে বলা হয়। তা-ও বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় বন বিভাগের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭ সালের মার্চ-আগস্ট মাসে রেল ও সড়কপথে মারা গেছে ১৩টি লোপার্ড, ৬টি গন্ধগোকুল, ৫টি বানর, ২টি চশমাপরা হনুমান, ৪টি মায়াহরিণ, ১টি লিজার্ড, ১টি সঙ্খিনি, ১টি অজগর, ৪টি দাঁড়াশ, ১টি সবুজ ডোরা, ১টি শিয়াল, ১টি শজারু, ৫টি লজ্জাবতী বানর, ২টি চশমাপরা হনুমান, ১টি বন্য শূকর ও ২টি ভাইপার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গবেষণা করে বন বিভাগের কাছ দিয়ে যাওয়া এক প্রতিবেদনে বলেন, ওই দুই মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় বিভিন্ন রকমের ৯৯টি বন্যপ্রাণী মারা যায়।
এ ছাড়া ২০১১ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অজগর সাপের ওপর গবেষণা করতে এসে গবেষকরা এক বছরে জাতীয় উদ্যানে ৩৫ প্রজাতীয় ৭০০ মরা সাপ দেখতে পান। বানর, হরিণ, শজারুসহ বনের অন্য প্রাণীরাও মারা পড়ছে।
প্রাণ-প্রকৃতি গবেষকরা মনে করেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অব্যবস্থাপনা আর অবহেলায় কারণেই প্রাণীরা মারা পড়ছে।
সম্প্রতি লাউয়াছড়া সড়কে গাড়িচাপায় দুটি বানরের মৃত্যু হয়। একটি মৃত বানরের কাছে এসে কাঁদতে দেখা যায় তার বাচ্চাকে। এ ছবিটি নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়, কেঁদে ওঠে মন।
কিন্তু এভাবে আর কত প্রাণীর মৃত্যু হলে ঘুম ভাঙবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। নেওয়া হবে কার্যকর উদ্যোগ? প্রাণীদের মৃত্যুতে আমাদেরই তো ক্ষতি হচ্ছে। এই প্রাণীরা আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করছে। পরাগায়নে সহায়তা করছে। বিভিন্ন দূষণ থেকে রক্ষা করছে পরিবেশ। তাই আর কালবিলম্ব না করে লাউয়াছড়া বনের প্রাণীদের রক্ষা করতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, প্রাণীরা বাঁচলে বাঁচবে মানুষ, বাঁচবে প্রকৃতি।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী