যাবতীয় সম্মান ও মর্যাদার মালিক মহান আল্লাহ। সম্মান হচ্ছে মানবজীবনের এক মূল্যবান অলংকার, যা একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে আসে। তিনিই যাবতীয় সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের মালিক। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন।
নিম্নে আল্লাহার কাছে মর্যাদা বৃদ্ধির বিশেষ ১০ আমল নিয়ে আলোচনা করা হলো—
১. তাকওয়া অবলম্বন করা : তাকওয়া বা আল্লাহভীরুতা বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে। আকাশবাসী ও জমিনবাসীর কাছে তাকে সম্মানিত করে তোলে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে পরহেজগার বান্দাকে সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তিরূপে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত ওই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
২. দ্বিনি জ্ঞান অর্জন করা : যারা দ্বিনি জ্ঞান অর্জন করে এবং সেই জ্ঞান জীবনে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, আল্লাহ তাদের জগদ্বাসীর কাছে সম্মানিত করে তোলেন এবং পরকালেও তাদের জন্য সম্মানিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তা ভালোভাবে খবর রাখেন।’ (সুরা : মুজাদালাম, আয়াত : ১১)
৩. তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা : তাহাজ্জুদ সালাত শুধু একটি নফল ইবাদত নয়, বরং এটি এক রুহানি সফর, যা বান্দাকে পৌঁছে দেয় আল্লাহর নৈকট্যে।
তাহাজ্জুদ আদায়কারীরা কিয়ামতের দিন প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে, যা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত ইবাদত। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।’
(সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯)
৪. মাতা-পিতার জন্য সন্তানের দোয়া : মাতা-পিতা যদি কোনো পরহেজগার সন্তান দুনিয়ায় রেখে যান আর সে তার মাতা-পিতার জন্য দোয়া করে বা ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে সেই দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ জান্নাতে মাতা-পিতার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ জান্নাতে তাঁর কোনো নেক বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন।
এ অবস্থা দেখে সে (নেক বান্দা) বলবে, হে আমার রব! আমার এ মর্যাদা কিভাবে বৃদ্ধি পেল? তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তান-সন্ততির ক্ষমা প্রার্থনা করার কারণে।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৩৬৬০)
৫. কোরআনের ধারক-বাহক হওয়া : কোরআন এমন এক আলোকবর্তিকা, এর সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়েছে, আল্লাহ তাকে উঁচু মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন; আর যে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে নিপতিত হয়েছে লাঞ্ছনার অন্ধকারে। যারা দুনিয়ায় কোরআন শিখবে এবং সে মতো আমল করবে, কোরআন হিফজ করবে। কিয়ামতের দিন তাদের বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, কোরআন কিয়ামত দিবসে হাজির হয়ে বলবে, হে আমার রব, একে (কোরআনের বাহককে) অলংকার পরিয়ে দিন। তারপর তাকে সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার রব, তাকে আরো পোশাক দিন। সুতরাং তাকে মর্যাদার পোশাক পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার রব, তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। কাজেই তিনি তার ওপর সন্তুষ্ট হবেন। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি একেক আয়াত পাঠ করতে থাকো এবং ওপরের দিকে উঠতে থাকো। এমনিভাবে প্রতি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব (মর্যাদা) বাড়ানো হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১৫)
৬. নবীজির প্রতি দরুদ পড়া : আকাশবাসী ও জমিনবাসীর কাছে নিজের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করার একটি বড় মাধ্যম হলো দরুদ। যারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে, প্রতি দরুদে আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। দরুদ পাঠ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং তার পাপ মোচন করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর ১০ বার রহমত বর্ষণ করেন, তার ১০টি গুনাহ ক্ষমা করে দেন এবং তার মর্যাদা ১০ গুণ বৃদ্ধি করেন।’
(নাসাঈ, হাদিস : ১২৯৭)
৭. কল্যাণকর ও উত্তম কথা বলা : উত্তম কথা বলা ইবাদত। এটি বান্দার মর্যাদা বাড়ায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ সহজ করে দেয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই বান্দা কোনো কোনো সময় আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক এমন কথা বলে ফেলে, যে কথা সম্পর্কে তার চেতনা নেই। অথচ এ কথার দ্বারা আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আবার বান্দা কখনো আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক এমন কথা বলে ফেলে, যার পরিণতি সম্পর্কে তার ধারণা নেই। অথচ সে কথার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৮)
৮. ইসলামের ছায়াতলে চুল-দাড়ি পাকা : মুসলিম ব্যক্তির চুল-দাড়ি সাদা হওয়া বা পেকে যাওয়া তার মর্যাদা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শুভ্র কেশ বা পাকা চুল তুলে ফেলো না। কেননা তা কিয়ামতের দিন নুর (জ্যোতি) হবে। ইসলামে যে ব্যক্তির একটি চুল সাদা হবে, সে ব্যক্তির প্রত্যেক সাদা চুলের বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য একটি করে নেকি লিপিবদ্ধ করবেন, একটি করে গুনাহ মুছে দেবেন এবং একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।’ (ইবনু হিব্বান, হাদিস : ২৯৮৫)
৯. গোপন আমলে অভ্যস্ত হওয়া : গোপন নেক আমল বান্দার মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি কোরআন, হাদিস ও মুসলিম মনীষীদের বাণীতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) বলেন, ‘কেউ যদি কোনো গোপন নেক আমল করতে সক্ষম হয়, তবে সে যেন তা করে।’ মুসনাদে ইবনিল জাদ, পৃষ্ঠা-১১৩)
কিয়ামতের ময়দানে মহান আল্লাহ যে সাত শ্রেণির বান্দাকে ছায়া দান করবেন, তার মধ্যে তিন শ্রেণির লোক হবে গোপন আমলকারী। যেমন—নবী করিম (সা.) বলেন, সেদিন সাত শ্রেণির ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না।...(তন্মধ্যে অন্যতম হলো) ওই ব্যক্তি, যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহ্বান জানায়, কিন্তু সে এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি।’ আর সেই ব্যক্তি ছায়া পাবে, যে এমন গোপনে দান করে যে তার ডান হাত কী ব্যয় করে বাঁ হাত সেটা জানতে পারে না। অতঃপর সে ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়। (বুখারি, হাদিস : ৬৬০)
১০. ঈমান আনা ও নেক আমল করা : সম্মানিত জীবন লাভের প্রধান শর্ত হলো ঈমান। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ প্রকৃত সম্মানের অধিকারী হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি তাঁর কাছে হাজির হয় সৎকর্মসমূহ সম্পাদনকারী মুমিন হিসাবে, তাদের জন্য আছে উচ্চ স্তরের মর্যাদা। আর আছে স্থায়ী বসবাসের বাগিচা, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটা কেবল তাদেরই প্রতিদান, যারা (ভেতরে-বাইরে) পরিশুদ্ধি অর্জন করেছে।’ (সুরা : ত্ব-হা, আয়াত : ৭৫-৭৬)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন