চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় কওমি ও তরিকতপন্থি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত মতাদর্শীদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে যুগের পর যুগ। তাদের আকিদাগত মতপার্থক্যের সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব। তরিকতপন্থিরা সুফি ধারার অনুসারী। তারা পীর-আউলিয়া, মাজার জিয়ারত, মিলাদ-কিয়াম ও ওরসের মতো আচার-অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করে থাকেন। কওমিরা এসব প্রথাকে ইসলামবিরোধী মনে করেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ বিরোধ প্রায়ই ওয়াজ-মাহফিল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র আকার ধারণ করে, যা মাঝে মাঝে সহিংসতার জন্ম দেয়। সর্বশেষ গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টের জের ধরে দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব ও শীর্ষ কওমি নেতা মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘তথাকথিত সুন্নিরা ঈদে মিলাদুন্নবীসহ কিছু বিষয় সংযোজন করে ইসলামের নামে পালন করে আসছে। যা শরিয়তের দৃষ্টিতে বেদাত। ইসলাম যা সমর্থন করে না তার বিরোধিতা করছি আমরা। তাদের সঙ্গে আমাদের মূল দ্বন্দ্বই হচ্ছে আকিদা নিয়ে।’ ‘বৃহত্তর সুন্নি জোট’-এর শীর্ষ নেতা ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মজলিসে শুরা সদস্য মাওলানা এম এ মতিন বলেন, ‘কওমিদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্বের মূল কারণই হচ্ছে আকিদা। তারা বেদাত বলে পীর আউলিয়াদের অস্বীকার করে। আকিদাগত এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও কওমিরা তাতে সাড়া দেয়নি। তাই বিষয়গুলো অমীমাংসিতই থেকে গেছে।’
জানা যায়, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা কওমি মতাদর্শী এবং তরিকতপন্থি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত মতাদর্শীদের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। দুই পক্ষ ইসলামিক মতাদর্শের হলেও তাদের রয়েছে ‘আকিদাগত’ বড় ধরনের মতপার্থক্য। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রধান কেন্দ্র হাটহাজারীতে রয়েছে দেশের বৃহৎ কওমি মাদরাসা ‘আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা। যা কওমি আন্দোলনের একটি প্রধান স্তম্ভ। এ প্রতিষ্ঠানের অনুসারীরা ইসলামে কোনো ধরনের ‘বেদাত’ বা নতুনত্বের ঘোরবিরোধী। অন্যদিকে একই উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য সুফি-সাধক ও পীর আউলিয়ার মাজার ও দরবার। তরিকতপন্থিরা সুফি ধারার অনুসারী। তারা এসব পীর-আউলিয়ার মাজারে জিয়ারত, ওরস শরিফ এবং মিলাদ-কিয়ামের মতো আচার-অনুষ্ঠান করে থাকেন। এ বিষয়গুলো কওমি মতাদর্শের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কওমিরা এ প্রথাগুলোকে ইসলামবিরোধী বলে মনে করেন এবং এর তীব্র বিরোধিতা করে ‘শিরক’ ও ‘বেদাত’ হিসেবে গণ্য করেন। এ বিভাজনই তাদের বিরোধের প্রধান কারণ। যা ওয়াজ মাহফিলগুলোতে প্রায়ই উভয় পক্ষ একে অপরের বিশ্বাস ও আচার-আচরণ নিয়ে কটাক্ষ করে এবং যা উভয় পক্ষের উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হয় প্রায়ই। আরও জানা যায়, উভয় পক্ষই স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়। হাটহাজারীর কওমি মাদরাসাগুলোতে রয়েছেন বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক নিয়ে, যা তাদের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তি দিয়েছে। একইভাবে সুন্নি অনুসারীদেরও বিশাল একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা জোটের সঙ্গে যুক্ত। এ রাজনৈতিক বিভাজন প্রায়ই তাদের মধ্যে সংঘাতের জন্ম দেয়। হাটহাজারী ও তার আশপাশের অঞ্চলে উভয় মতাদর্শের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মধ্যে প্রায়ই আধিপত্য ও নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ হয়। তাদের অনুসারীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে এবং অনেক সময় তা সহিংসতায় রূপ নেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাটহাজারীতে এই বিরোধের জেরে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ওয়াজ মাহফিলগুলোতে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা খুবই সাধারণ ব্যাপার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই দ্বন্দ্ব বেশ তীব্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো প্ল্যাটফর্মে উভয় পক্ষ একে অপরের মতবাদকে ভুল প্রমাণ করতে এবং তাদের নেতাদের হেয় করতে বিভিন্ন পোস্ট ও ভিডিও প্রকাশ করে।