বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের কিছু প্রচলিত ঠিকানা আছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে প্রায় ৮০ হাজার কোটি। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের মূল গন্তব্য হচ্ছে কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রসহ উন্নত কিছু দেশ, যাদের ট্যাক্সহ্যাভেন বা কর ফাঁকির অভয়ারণ্য বলা হয়। এর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ আছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, কেম্যান আইল্যান্ড, বারমুডা, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, হংকং, জার্সি, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক (টিজেএন) বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে কর ফাঁকি দিয়ে যে পরিমাণ অর্থ করস্বর্গখ্যাত দেশগুলোতে পাচার হয়, তার পরিমাণ ৪২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
সরকার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় প্রথম একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছিল ২০১৫-১৯ সময়ের জন্য। এর নাম ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফাইন্যান্স অব টেররিজম। পরে আরেকটি কৌশলপত্র করা হয় ২০১৯-২১ সময়ের জন্য। এরপর আর কৌশলপত্র হয়নি। আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী এ কৌশলপত্র তৈরি করাটা একটা চর্চা, যা প্রায় সব দেশই করে থাকে।
কৌশলপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হওয়া শীর্ষ ১০ দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কেম্যান আইল্যান্ড এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড। কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রসহ উন্নত কিছু দেশ, যাদের ট্যাক্সহ্যাভেন বা কর ফাঁকির অভয়ারণ্য বলা হয়। এর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ আছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ড, বারমুডা, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, হংকং, জার্সি, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
শাহরিয়ার আলম এখানেই আলাদা। টাকা পাচারের এসব প্রচলিত গন্তব্যে তিনি তাঁর লুটের টাকা পাচার করেননি। তিনি টাকা পাচারের নতুন ঠিকানা রীতিমতো আবিষ্কার করেছেন। শাহরিয়ার তাঁর অবৈধ অর্থ পাচার করেছেন রাশিয়া এবং ব্রাজিলে। এ দুই দেশে রয়েছে তাঁর বিপুল বিনিয়োগ। গত বছরের ৫ আগস্টের পর শাহরিয়ার আলম দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। সেখানে গোপনে গড়ে তোলা বিভিন্ন ব্যবসা সামলাচ্ছেন।
এসবারব্যাংক, গ্যাজপ্রমব্যাংক এবং আলফা ব্যাংকে তাঁর একাধিক অ্যাকাউন্ট আছে বলে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। শাহরিয়ার আলমের বিদেশভ্রমণসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি ২৪৭ বার রাশিয়া সফর করেন। এর মধ্যে ২০৯ বার সফর করেন কূটনৈতিক পাসপোর্টে। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বিশ্বকূটনীতির বাস্তবতায় বাংলাদেশের একজন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এতবার রাশিয়া সফরের কোনো প্রয়োজন ছিল না। শাহরিয়ার আলমের বিদেশভ্রমণসংক্রান্ত জিও বা সরকারি আদেশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিকাংশ সফরই ছিল ব্যক্তিগত। শাহরিয়ার আলমের ঘনিষ্ঠরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পুরোনো, মন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই। তাঁর কিছু বন্ধু রাশিয়ায় বসবাস করছেন দীর্ঘদিন ধরে। রাশিয়ায় পড়াশোনা করতে গিয়ে তাঁরা আর ফিরে আসেননি। সেখানেই ব্যবসা করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শাহরিয়ার যখন গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করেন তখন এই বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা শাহরিয়ারের কাছ থেকে বিভিন্ন পোশাক কিনে রাশিয়ায় বিক্রি শুরু করেন। এমপি এবং মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর এ ব্যবসা আরও বেড়ে যায়। অবৈধ টাকায় তিনি সেখানে অনেক শোরুম তৈরি করেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়া অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগসুবিধা অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি করে। উৎস যাচাই ছাড়াই যত খুশি টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে শাহরিয়ার বিপুল অর্থ রাশিয়ায় পাচার করেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাশিয়ায় তাঁর অন্তত তিনটি বাড়ি, দুটি গার্মেন্ট এবং ২১টি শোরুম রয়েছে।
রাশিয়ার পাশাপাশি ব্রাজিলেও শাহরিয়ারের ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশে তাঁর গার্মেন্ট থেকে পণ্য ব্রাজিলে রপ্তানি হয়। এ রপ্তানির টাকা দেশে আসেনি। ব্রাজিলে কোম্পানি খুলে সেখানে রেখেছেন। বাংলাদেশের অর্থ পাচার আইন অনুযায়ী এটি অপরাধ। বাংলাদেশ থেকে ১৫ বছরে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন শাহরিয়ার আলম।