জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে। গণভোট কখন হবে তা নিয়ে নতুন করে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির পরস্পরবিরোধী অবস্থানে এ উত্তাপের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের দাবিতে অনড়। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোটের দাবি জামায়াতের। আর এনসিপি বলছে গণভোট যে কোনো সময় হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও ঐকমত্য কমিশনের কর্মকাণ্ডের কারণে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তীব্র হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তারা এখন এমন প্রস্তাব দিয়েছে, যা জাতিকে বিভক্ত করবে, অনৈক্য সৃষ্টি করবে। এর ভিত্তিতে কোনো ঐকমত্য হবে না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমরা হতাশ। দলটির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের আগে গণভোট এটির সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। এ ব্যাপারে আর আলোচনা করার সুযোগ নেই।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, অবিলম্বে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। গণভোটের তারিখ ঘোষণায় যত দেরি হবে, জাতীয় নির্বাচন তত সংকটের মধ্যে পড়বে। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, গণভোট নিয়ে দেশে অনেক তর্কবিতর্ক চলছে; এটি আগে হবে না পরে হবে। আমরা তর্কবিতর্কে যাব না। আমরা মনে করি গণভোট যে কোনো সময় হতে পারে, তবে তা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় হওয়া প্রয়োজন।
সংশ্লিটরা বলছেন, ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নানা ইস্যুতে ৩০টির অধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি বারবার জাতীয় ঐক্য গড়ার তাগিদ দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ার ওপর গুরুত্ব দেন। কিন্তু গণ অভ্যুত্থানের পর কয়েক মাস রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে অনৈক্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সর্বশেষ জুলাই সনদে এসসিপিসহ বেশ কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর না করায় সেই অনৈক্য আরও বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
এদিকে সনদে স্বাক্ষর করলেও নভেম্বর মাসে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে রয়েছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি রাজনৈতিক দল। তবে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে দাবি জানাচ্ছে তার ঘোর বিরোধী বিএনপি। এ ছাড়া এই দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান রয়েছে এনসিপির। অপরদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মতো ঘটনাও ঘটছে। এর আগে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগ ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা একে অন্যকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। সব মিলিয়ে নানা ইস্যুতে গণ অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য দৃশ্যমান হচ্ছে।
এদিকে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে আত্মবিশ্বাসী অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে নানামুখী প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলও ভোটের মাঠে নেমে পড়েছে। তবে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, চ্যালেঞ্জও বাড়ছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান এ উত্তাপের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা জোটগতভাবে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের কথা বলেছি। তবে সব সমস্যা সমাধানের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের দিনে যদি গণভোট হয়, সব দিক থেকে বিবেচনাপ্রসূত হবে। এতে একদিকে সময় বাঁচবে। আর ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে এত বড় একটা আয়োজন করা বাস্তবে সম্ভব নয়। এটা করতে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোর এটা নিয়ে বিভক্তি তৈরি হতে পারে; তখন সন্দেহ-অবিশ্বাস নতুন মাত্রা নেবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশে অরাজক অবস্থা সৃস্টি হবে। রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, নির্বাচিত সরকার বৈধতা না দেওয়া পর্যন্ত জুলাই সনদ বৈধতা পাবে না।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, জুলাই সনদের নামে রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নামে ড. ইউনূস তিনটি দলকে এ ক্যাটাগরিতে স্থাপন করে ছোট দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পুরো বিষয়টি একটি রাজনৈতিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখানে সবাই কৌশলী আচরণ করছে। তবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখাও খুব জরুরি। তা না হলে যদি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন বাড়তে থাকে, বিশেষ করে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নাম উল্লেখ করে তালিকা দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন। উনি নিশ্চয় সবকিছু জেনে বুঝেই বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা এক বছরের বেশি সময় ধরে কথা বলছেন, তাদের (দলগুলো) সম্পর্কে নিশ্চয় ওনার ধারণা হয়েছে।