গণভোটের পাশাপাশি নির্বাহী আদেশ ও অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে না কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের বক্তব্য-কমিশন নিজেদের মনমতো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে থেকে ওই দুই বিষয় নিয়ে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘চাপিয়ে দেওয়া’র নীতি অবলম্বন করেছে বলে মন্তব্য করেন তারা। বিষয়টিকে বিপজ্জনক প্রবণতা বলে জানান তারা।
মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ হস্তান্তর করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
জুলাই সনদে থাকা সুপারিশগুলোর মধ্যে ৯টি সুপারিশ নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যাবে বলে মনে করে কমিশন। অন্যদিকে ২৮টি সংস্কার প্রস্তাব অধ্যাদেশ জারি করে বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছে। এর বাইরে সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয় গণভোটের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি প্রদান এবং বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। জাতীয় সনদে সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি, এরপর সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য গণভোট নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব সুপারিশ প্রসঙ্গে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরকারী দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংসদ গঠনের পর বিল আকারে এসব বিষয় উত্থাপন হবে ও এমপিদের ভোটে পাস হলে সেটার আইনি ভিত্তি তৈরি হয়। তার আগেই আদেশ দিয়ে কোনোকিছু আইনে পরিণত করাটা বিপজ্জনক প্রবণতা বলে মনে করি। কারণ এটাকে এখন আ্যালাউ করলে ভবিষ্যতে কোনো পরিস্থিতিতে সংবিধান সংশোধনের জন্য আর নির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রয়োজন হবে না। কোনো একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্বাহী আদেশ দিয়েই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে। তিনি বলেন, এটা ভয়ানক বিপজ্জনক। এ ধরনের উদ্যোগের মধ্যে ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ এবং ফ্যাসিবাদ শাসনের ভিতটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে।
নির্বাহী আদেশে যেসব সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব বলে সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের জনবল বৃদ্ধি, আদালত ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও ডিজিটাইজ করা, আইনজীবীদের আচরণবিধি, গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠন, কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি প্রশাসনিক বিভাগ গঠন, দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, পরিষেবা খাতের কার্যক্রম ও তথ্য অটোমেশন করা এবং ওপেন গভর্নম্যান্ট পার্টনারশিপ এর পক্ষভুক্ত হওয়া।
অন্যদিকে অধ্যাদেশ জারি করে যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো- নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি, সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠন, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাকে অধিদপ্তরে রূপান্তর, কতিপয় আইন রহিতকরণ ও সংশোধন, আইনজীবী সমিতি ও বার কাউন্সিল নির্বাচন, বিচারকদের রাজনৈতিক দলীয় আনুগত্য নিয়ে বিধান (বিচারকদের রাজনৈতিক দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করা হবে), তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর সংশোধন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ এর সংশোধন, স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, প্রজাতন্ত্রের জনবল নিয়োগের তিনটি সরকারি কর্ম কমিশন গঠন, (ক) সরকারি কর্ম কমিশন (সাধারণ), (খ) সরকারি কর্ম কমিশন (শিক্ষা), এবং (গ) সরকারি কর্মকমিশন (স্বাস্থ্য), হিসাব বিভাগ থেকে নিরীক্ষা বিভাগ আলাদাকরণ, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের চর্চা বন্ধ করা, রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে সুবিধাভোগী মালিকানা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করা, জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ, দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের করণীয়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর সংশোধন, বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি কর্তৃক দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম পর্যালোচনার পদ্ধতি, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ধারা ৩২ক বিলুপ্ত করা, আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ৩০৯-এর সংশোধন, বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকে শাস্তির আওতায় আনা এবং কমন রিপোর্টিং স্টান্ডার্সের বাস্তবায়ন।