বর্তমান সময়ে ট্রান্সজেন্ডারিজম নামক একটি ধারণা বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মতো ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। আধুনিক বিশ্বে ট্রান্সজেন্ডারিজমের নামে যে বিপজ্জনক সামাজিক পরীক্ষা চালানো হচ্ছে, তা কেবল পশ্চিমা দেশগুলোকেই নয়, আমাদের মতো ধর্মনিষ্ঠ সমাজকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। এই ধারণার প্রবক্তাদের মতে ব্যক্তির শারীরিক লিঙ্গ নয়, বরং তার মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতিই তার লিঙ্গ-পরিচয় নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ একজন পুরুষশরীরী ব্যক্তি যদি নিজেকে নারী মনে করেন, তবে তাকে নারী হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হবে এবং বিপরীতটিও সত্য। এই ধারণা শুধু লিঙ্গের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করছে না, বরং এটি মানবসভ্যতার মৌলিক কাঠামোকেই ধ্বংস করার পথ প্রশস্ত করছে। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে বিবাহ, সম্পত্তির বণ্টন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, হোস্টেল বরাদ্দ, পাবলিক টয়লেট ব্যবহারসহ নানা ক্ষেত্রে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ : ইসলাম নর ও নারীর স্বতন্ত্র সৃষ্টি ও ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন’ (কোরআন, ৪২:২৫)। এই আয়াত থেকে স্পষ্ট, আল্লাহতায়ালা মানুষকে নর ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। ট্রান্সজেন্ডারিজম এই স্বাভাবিক ধর্মীয় ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে, যা সরাসরি আল্লাহর সৃষ্টিনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারের পার্থক্য : অনেকে হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডারকে একই মনে করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। হিজড়ারা জন্মগতভাবে শারীরিক অস্পষ্টতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শরিয়তে তাদের জন্য সুস্পষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। অন্যদিকে ট্রান্সজেন্ডাররা কেবল নিজেদের লিঙ্গ-পরিচয়কে মানসিকভাবে অস্বীকার করেন। তবে এটাও সত্য, বাংলাদেশে হিজড়া নামে পরিচিত অনেকেই মূলত ট্রান্সজেন্ডার। তারা বৈষয়িক সুবিধার জন্য প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে হিজড়া হিসেবে সমাজে বসবাস করছে।
মানবসভ্যতার জন্য হুমকি : আল্লাহতায়ালা নর ও নারীকে সৃষ্টি করেছেন তাদের স্বকীয়তা ও ভূমিকা দিয়ে। এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে বিকৃত করলে পরিবার, সমাজ ও মানবসভ্যতার অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
পরিবারব্যবস্থা ধ্বংস ও ঘৃণ্য সমকামিতার প্রসার : পরিবার হলো সমাজের মৌলিক একক, যা নর ও নারীর মধ্যে বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে গঠিত হয়। ট্রান্সজেন্ডারিজম এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সমকামিতাকে উৎসাহিত করছে। যদি একজন পুরুষ নিজেকে নারী ঘোষণা করে আরেকজন পুরুষকে বিয়ে করে, অথবা একজন নারী নিজেকে পুরুষ ঘোষণা করে আরেকজন নারীকে বিয়ে করে, তাহলে এটি সমকামিতার বৈধতা হিসেবেই পরিগণিত হবে। এটি ঘটলে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির আর কোনো অর্থই থাকবে না। এর ফলে শিশুরা বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে, যা সমাজে অপরাধ, হতাশা ও নৈরাজ্য বাড়াবে।
সম্পত্তি বণ্টন : কন্যাসন্তানরা সম্পত্তির বেশি অংশ লাভের জন্য নিজেদের পুরুষ দাবি করতে পারে। এতে পারিবারিক ও আইনগত জটিলতা বাড়বে।
নিরাপত্তাহীনতা : ট্রান্সজেন্ডারিজমের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো নারী ও শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা। যদি কোনো পুরুষ নিজেকে নারী দাবি করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত স্থানগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়, তাহলে নারীরা কোথায় নিরাপদ থাকবে? পশ্চিমা বিশ্বে ইতোমধ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ট্রান্সজেন্ডার নারী (জৈবিক পুরুষ) নারীদের কারাগার, গণশৌচাগার ও ড্রেসিং রুমে ঢুকে নারীদের হয়রানি ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করেছে। বাংলাদেশে একে সামাজিকীকরণ করা হলে এখানেও এরূপ সমস্যার উদ্ভব হবে।
সামাজিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন : গণপরিবহনে ভিড়ের মধ্যে কোনো পুরুষ যদি নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়ায় কিংবা নারীর জন্য নির্ধারিত সিটে বসে এবং পরে দাবি করে যে সে ‘নারী’, তবে তা সামাজিক শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হবে।
সন্ত্রাসবাদে উসকানি : ট্র্রান্সজেন্ডারিজম আজ আর শুধু একটি মতাদর্শগত আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন হুমকিধমকি ও সহিংসতার একটি নতুন হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের দুজন প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে ট্রান্সজেন্ডারিজমের বিরুদ্ধাচরণের কারণে। এর চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, দেশের কিছু রাজনীতিবিদ ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এই হুমকিদাতাদের পক্ষ নিচ্ছেন। তারা নিরীহ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একদিকে যেমন বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছেন, অন্যদিকে সহিংসতাকে উৎসাহিত করছেন। এমন পরিস্থিতিতে সমাজের বিবেকবান মানুষদের কঠোর অবস্থান নেওয়া উচিত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে।
জুমার বয়ান থেকে গ্রন্থনা
আবুল কাসেম আদিল