আমরা মানুষ। মানুষ হিসেবে আমাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। সেই সুবাদে বিভিন্ন কাজে আমরা আত্মনিয়োগ করে জীবিকা নির্বাহের পথে এগিয়ে যাই। হারাম থেকে বেঁচে হালাল পন্থায় যে কোনো কাজে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ ইসলামে অবারিত। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে নিজের কাজ করে যেতে নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষত নিজের ওপর যখন কোনো কাজ বা দায়িত্ব বর্তায় তখন উপযুক্ত শ্রম বিনিয়োগ বা কাজ সম্পাদন না করে অবহেলা বা ফাঁকি দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই নিন্দনীয় এবং অপরাধযোগ্য। প্রতিটি দায়িত্বই একটি আমানত। আর আমানতের যথার্থ হক আদায় করা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। পক্ষান্তরে দায়িত্ব পালন না করে অবহেলা প্রদর্শন আমানত খেয়ানতের নামান্তর।
কর্মক্ষেত্রে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব-যা নিঃসন্দেহে আমানত যথাযথ পালন করা ইমানের অনন্য বৈশিষ্ট্য। একজন মুমিনের দ্বারা কখনো আমানতের খেয়ানত হবে এটা অকল্পনীয়। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা সফল মুমিনের পরিচয় উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘(মুমিনদের অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে) যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে (সূরা মুমিনুন-৮)’। যারা নিজেদের মুমিন বলে দাবি করেন অথচ আমানত রক্ষায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন না, নবীজি (সা.) তাদের দাবিকে যথার্থ নয় বলে ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘যে আমানত রক্ষা করে না, তার ইমানের দাবি যথার্থ নয়। এবং যে অঙ্গীকার পূরণ করে না তার দ্বীন যথার্থ নয়’ (মুসনাদে আহমাদ)।
ইসলামে আমানতের পরিধি অনেক বিস্তৃত। একজন চাকরিজীবীর জন্য তার কাজের নির্ধারিত সময়টুকুও আমানত হিসেবে গণ্য। কাজ রেখে নির্ধারিত সময়ে গল্প-গুজবে মেতে ওঠা বা কাজে ফাঁকি দেওয়া খেয়ানতের শামিল। অফিসের জিনিসপত্রও কর্মীর কাছে আমানত। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত কাজে তা ব্যবহার করা বা নষ্ট করা পুরোপুরি নিষেধ। এমন কাজে জড়িয়ে আমানতের খেয়ানত করার ব্যাপারে হাদিসে কঠিন তিরস্কার এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি। তা হলো মিথ্যা কথা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা’ (বুখারি)। যথার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে আমানত রক্ষায় আত্মনিয়োগ করা ইসলামের অবশ্যপালনীয় নির্দেশনা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলো প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন মানুষের বিচার-মীমাংসা করবে, তখন ন্যায়ভিত্তিক মীমাংসা কর। আল্লাহ তোমাদের সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী’ (সুরা নিসা : ৫৮)। রসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্বশীলতার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে’ (সহিহ বুখারি ও জামে তিরমিজি)।
একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি ঠিক সময়ে অফিসে আসবেন। কর্তব্য পালনে ফাঁকি, অবহেলা বা অলসতার আশ্রয় নেবেন না-এটাই প্রত্যাশিত। সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রয়োগ করে কাজের মান নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। দায়িত্বে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, তোমরা যেন নিশ্চয় মালিকের কাছে তাঁর আমানত প্রত্যর্পণ কর’ (সুরা নিসা : ৫৮)।
যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। নামাজ-রোজার মতোই সেগুলো মেনে চলা ফরজ। যেমন ব্যবসায়ী কখনো ধোঁকা প্রতারণার আশ্রয় নেবে না, ভেজাল দেবে না। চাকরিজীবী সময়মতো কর্মস্থলে আসবে, পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। কাজে যদি নিয়মবহির্ভূত সময়ক্ষেপণ করা হয়, সেটা প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে। ইসলাম এসব কখনই সমর্থন করে না। বরং নিয়মভঙ্গের জন্য শাস্তির কথা বলে। আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় নেয়, আর-দেওয়ার সময় কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩)। ইসলামি আইনজ্ঞদের ভাষ্যমতে, এখানে মাপে কম-বেশি করার অর্থ হলো পারিশ্রমিক পুরোপুরি আদায় করে নিয়ে কাজে গাফিলতি করা। কাজে ফাঁকি দিয়ে ওই সময় অন্য কাজ করা বা সময়টা অলস কাটিয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রসুল (সা.) বলেন, ‘আমরা যখন কাউকে দায়িত্ব প্রদান করি, সে যদি এক টুকরো সুতা বা তার চেয়েও কোনো ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে, তবে কিয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে।’ বিভিন্ন হাদিসের আলোকে জানা যায়, কাজে ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তি কখনো নিজেকে পূর্ণ মুসলমান দাবি করতে পারে না। কারণ ফাঁকির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থসম্পদ হারাম। আর হারাম উপার্জনের খাদ্য গ্রহণ করে কোনো ইবাদত পালন করলে আল্লাহ তা কবুল করেন না।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর