একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন ওলিউর রহমান। একদিন তাঁর টেলিগ্রাম আইডিতে মেসেজ আসে, ‘ঘরে বসে টাকা ইনকামের সুযোগ’। বিষয়টিতে আগ্রহ তৈরি হওয়ায় তিনি ওই লিঙ্কে প্রবেশ করেন। এরপর মুশফিকা জাহান ইভা নামে একটি আইডি থেকে তাঁকে মেসেজ পাঠানো হয়, ‘ঘরে বসেই অনলাইনে ট্রাভেল এজেন্সির টিকিট প্রমোশন করে আয় করতে হলে অনট্রাভেল ওয়ার্ল্ডট্রিপ নামে ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।’ সেখানে রেজিস্ট্রেশন করার পর তাঁকে ‘অনট্রাভেল কমিউনিটি ৯৬৭৫’ নামে টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করা হয়। পরে তাদের দেওয়া ৮৪টি টিকিট প্রমোশনের বিনিময়ে ৭০০ টাকা পাঠানো হয় বিকাশে। এতে তাদের প্রতি বিশ্বাস জন্ম নিলে তারা আরও অধিক লাভ দিতে বিনিয়োগের আহ্বান জানায়। শুরুতে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লভ্যাংশসহ ১৪ হাজার ৩৭০ টাকা পান ওলিউর। তাদের শর্ত মোতাবেক ২১ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৪০ হাজার টাকা পান। এতে আরও বিশ্বাস বেড়ে যায় তাঁর। এরপর ৭০ শতাংশ লভ্যাংশের আশ্বাস দিলে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। শুরু হয় নাটকের। বিমানের ফার্স্ট ক্লাস টিকিট প্রমোশনের সময় অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ হয়ে গেছে জানিয়ে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬৩ টাকা ডিপোজিট করতে বলা হয়। তাদের কথামতো টাকা জমা দেওয়ার পর আবারও অ্যাকাউন্ট নেগেটিভের কথা বলে ৯ লাখ ১৯ হাজার ৯২৭ টাকা জমা দিতে বলে। এ টাকা তাৎক্ষণিক দিতে না পারায় ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সময় বাড়িয়ে নিতে বলা হয়। কথা অনুযায়ী সময় বাড়িয়ে নিয়ে ওই টাকা দেওয়ার পর আচমকা ভিন্ন একটি ব্যবসার কথা বলে ৪০ গুণ লভ্যাংশের প্রস্তাব দিয়ে প্রায় ১৮ লাখ টাকা জমা দিতে বলা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে ৩৩ লাখ টাকা দেওয়ার পর মুনাফাসহ ৫৬ লাখ টাকা জমা হয় তাঁর আইডিতে। এ টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ওই সদস্যকে বিষয়টি জানান, তখন সিকিউরিটি মানি হিসেবে ২৮ লাখ টাকা জমা দিতে বলা হয়। ওই টাকা জমা না দিলে ৫৬ লাখ টাকা উত্তোলন সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। কিন্তু আর টাকা জমা দিতে না পারায় তাঁকে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হয়। তখন বুঝতে পারেন বিনিয়োগের নামে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে ৩৩ লাখ টাকা জমা দিতে গিয়েই খুইয়ে ফেলেছেন নিজের ঘরবাড়িসহ সর্বস্ব।
শুধু ওলিউর রহমানই নন, টেলিগ্রামের বিভিন্ন গ্রুপে যুক্ত হয়ে সহজে টাকা উপার্জনের প্রলোভনে অনেকটা ‘হাওয়ায় বিনিয়োগ’-এর মতো ট্যুরিজম, আবাসন ও জমি ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার নামে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসে যাচ্ছে হাজারো মানুষ। এ তালিকায় রয়েছেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তারাও। অনেক কোটিপতিও এসব চক্রের প্রলোভনে বাড়িগাড়ি বিক্রি করে ফকির হয়ে গেছেন। বর্তমানে টেলিগ্রামের গ্রুপে বিনিয়োগের নামে এ ধরনের প্রতারণা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে জানিয়েছে ডিবি পুলিশের সাইবার সেন্টার। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ তাঁদের কাছে এসেছে। বিভিন্ন মামলার তদন্তের সবশেষে গিয়ে দেখা গেছে, কিছু চায়নিজ ও ভারতীয় নাগরিক এ ধরনের প্রতারণায় জড়িত। তারা অনলাইনের মাধ্যমে শুধু টাকা লেনদেনের জন্য নিজেদের চক্রে যুক্ত করছে বাংলাদেশিদের। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এভাবে প্রতারণার শিকার বেসরকারি চাকরিজীবী রেজওয়ান বিশ্বাস বলেন, ‘গত জুনে টেলিগ্রামে অটোমিক কমিউনিটি-৪৬০৬ নামে একটি গ্রুপে যুক্ত হয়ে বিনিয়োগ শুরু করি। বিভিন্ন শর্তে ফেলে ৪২ লাখ ২৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।’ আরেক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী শাহ আলম মুন্সি বলেন, ‘দ্য মারলিন প্রজেক্ট নামে টেলিগ্রামের একটি গ্রুপে যুক্ত হওয়ার পর কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা।’ সবকিছু হারিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব।
কাটআউট সিস্টেমে নিরুপায় পুলিশ : ডিবির সাইবার সেন্টার সূত্র জানিয়েছেন, চক্রের বাংলাদেশি সদস্যরা বিভিন্ন নিরীহ মানুষকে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলায়। এরপর নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে উল্লিখিত ফোন নম্বরের সিমসহ অ্যাকাউন্টটি ভাড়া নেয়। এভাবে ১৫-২০টি অ্যাকাউন্ট জোগাড় হয়ে গেলে সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয় এ চক্রের বাংলাদেশি আরেক সদস্যের কাছে। পরে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নেয় চক্রের মূলহোতা। যখন কেউ বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়ে ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোয় টাকা পাঠায়, তখন দ্রুত টাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশি ভিন্ন সদস্যদের দিয়ে অন্য অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে ব্যাংকের ভার্চুয়াল লেনদেন মাধ্যম এনপিএসবি অথবা আরটিজিবি সিস্টেমের দ্বারা টাকা সরিয়ে ফেলা হয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে। লোকাল এজেন্টদের দিতে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টেও টাকা ট্রান্সফার করা হয়। সবশেষ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে টাকা পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বাইরে। সামগ্রিক এ প্রক্রিয়ায় কেউ কাউকেই চেনে না। সবারই অনলাইনের মাধ্যমে পরিচয়। ফলে মূলহোতা দেশের বাইরে থাকায় এবং পুরো লেনদেন এভাবে কাটআউট সিস্টেমে করায় তদন্তে নেমে বিপাকে পড়ছে পুলিশ। একটি মামলা তিন-চার মাস ধরে তদন্ত করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
এ বিষয়ে ডিবির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টারের (দক্ষিণ) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে মিথ্যা বিনিয়োগের নামে প্রতারণা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সবাইকে অনুরোধ করব অনলাইনে বিনা পরিশ্রমে টাকা আয়ের লোভ থেকে বিরত থাকার। বিশেষ করে সমাজমাধ্যমগুলো ব্যবহারের সময় মনে রাখতে হবে, যে কোনো সময় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সচেতনতা সবার মধ্যে তৈরি হলেই সব ধরনের অনলাইনভিত্তিক প্রতারণা কমে যাবে।’